ভাড়াটেরা কতটা নিরাপদ?

বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য বিরাজ করছে তা সরাসরি আইনের ব্যত্যয়। ছবি: প্রথম আলো
বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য বিরাজ করছে তা সরাসরি আইনের ব্যত্যয়। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা নগরবাসীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। বছরের শুরুতেই বাড়তি ভাড়া গোনার ভীতি তাঁদের তাড়া করে। সেই শঙ্কা এবার যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সিটি করপোরেশনের গৃহকর বাড়ানোর উদ্যোগ একদিকে বাড়ির মালিকদের প্রতিবাদী, অন্যদিকে ভাড়াটেদের শঙ্কিত করেছে; কারণ শেষ পর্যন্ত বর্ধিত করের বোঝা ভাড়াটের ওপর গিয়ে পড়বে। এমনিতে বিভিন্ন অজুহাতে বাড়িওয়ালারা ৭৫ শতাংশ ভাড়াটের প্রতিবছর ভাড়া বৃদ্ধি করেন। ২০১৬ সালে মিরপুর, বাড্ডা, রামপুরা ও পুরান ঢাকায় পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বর্ধিত ভাড়ার পরিমাণ ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। তবে, প্রথম আলোর ৬ জানুয়ারি ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানভেদে এবার ২ থেকে ৫ হাজার টাকা ভাড়া বেড়েছে।

গৃহকর বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া বেশি বাড়িয়েছেন। অথচ স্থানীয় সরকার বিভাগ গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশের সিটি করপোরেশনের গৃহকর বাড়ানোর প্রক্রিয়া স্থগিত করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালারাই ভাড়া বা বৃদ্ধির পরিমাণ ঠিক করেন। আলাপ-আলোচনায় সুযোগ থাকলেও অর্ধেকের বেশি ভাড়াটের ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালার সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক গবেষণা ‘স্টেট অব সিটিজ ২০১৭: হাউজিং ইন ঢাকা’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বাড়তি ভাড়া তিনটি বিকল্প উপায়ে ভাড়াটেরা সমন্বয় করেন। প্রথমত, জরিপে দেখা যায়, আবাসন ব্যয় মেটাতে অর্ধেকেরও বেশি ভাড়াটে পরিবারের খাবার, শিক্ষা, পোশাক, বিনোদন প্রভৃতির ব্যয় সংকোচন করেন; এতে মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। দ্বিতীয়ত, ভাড়া করা বাড়ি অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি, অর্থাৎ অল্প জায়গায় বেশি লোক বাস করেন। বাড়তি দামের কারণে মানুষ ছোট ও মাঝারি আয়তনের ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে বাড়ির ভেতরে জনপ্রতি আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় একজন মানুষ গড়ে ১২ দশমিক ৫ বর্গমিটার জায়গায় বাস করে, যা মুম্বাইতে ৩৩ দশমিক ২ বর্গমিটার এবং দিল্লিতে ৮৭ দশমিক ৪ বর্গমিটার। তৃতীয়ত, বর্তমান আবাসস্থল ছেড়ে তুলনামূলক কম ভাড়ায় ঢাকার প্রান্তিক এলাকায় বাস করেন। যানজটের এই শহরে সে সব মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়ে; তাঁদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং সন্তানদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে।

বাড়িওয়ালার প্রাধান্য এবং গ্রাহকসেবা গড়ে না ওঠার পেছনে বিরাজমান অপ্রাতিষ্ঠানিক বাড়িভাড়া পদ্ধতিকে দায়ী করা যায়। বাড়ি ভাড়া করা, থাকা বা ছেড়ে দেওয়া­-এসব বিষয়ে দুই-তৃতীয়াংশ বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের মধ্যে লিখিত চুক্তি নেই। চুক্তির অনুপস্থিতিতে বাড়িওয়ালা যেমন স্বেচ্ছাচারী আচরণের সুযোগ পান, অন্যদিকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেক ভাড়াটে বাসস্থানকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেন বা ভাড়া না দিয়েও জোর করে বাস করেন। ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোনো পক্ষই আইন-আদালতের আশ্রয় নিতে পারে না। ভাড়ার পরিমাণ, ভাড়া বৃদ্ধি, বাড়ি মেরামত, বাড়ি ছেড়ে দেওয়া-এসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।

বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য বিরাজ করছে তা সরাসরি আইনের ব্যত্যয়। ভাড়াটের স্বার্থ সুরক্ষায় ১৯৯১ সালে সরকার ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করে। আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও ভাড়া পরিশোধের বিপরীতে ৮৫ শতাংশ ভাড়াটেকে মুদ্রিত রসিদ দেওয়া হয় না। আইনে দুই বছর পরপর ভাড়া বৃদ্ধি, জামানতের পরিমাণ সর্বোচ্চ এক মাসের ভাড়ার সমপরিমাণ, চুক্তিনামা, নির্ধারিত ভাড়া দেওয়া সাপেক্ষে ভাড়াটেকে উচ্ছেদ না করার কথা বলা হয়েছে। বাড়িভাড়ার বিষয়াদি দেখভালের জন্য বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রক নিয়োগের বিধান রয়েছে। অথচ মাত্র ১৫ শতাংশ ভাড়াটে এসব নিয়ন্ত্রকের ব্যাপারে জানেন। তবে আইনের একটি বিষয় সেকেলে ও অবাস্তব। কোনো বাড়ি বা ভবনের সর্বোচ্চ বার্ষিক ‘স্বীকৃত ভাড়া’ (স্ট্যান্ডার্ড রেন্ট) হবে আলোচ্য বাড়ি বা ভবনের বাজারমূল্যের ১৫ শতাংশ। এই হারে যেকোনো এলাকার ৯৫০ বর্গফুটের বাড়ির মাসিক ভাড়া হবে আনুমানিক ৭০ হাজার টাকা। ঢাকার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত এলাকায় বর্তমানে এই আয়তনের গড় ভাড়া ১২ হাজার টাকার নিচে, তিন-চতুর্থাংশ ভাড়াটে এটাও বেশি মনে করেন।

২০০৩ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন গৃহকর নির্ধারণের লক্ষ্যে ‘হার তালিকা’ প্রণয়ন করে, যা ২০০৮ সালে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এলাকা, নির্মাণ সময় ও অবস্থানভেদে পাকা বাড়ির জন্য এই হার প্রতি বর্গফুট ৩ দশমিক ৫ টাকা থেকে ১৮ টাকা; আধা পাকা বাড়ির হার প্রতি বর্গফুট ২ দশমিক ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা এবং কাঁচা বাড়ির হার প্রতি বর্গফুট ২ থেকে ৯ টাকা। এই হারে বাড়িভাড়া নির্ধারণ করলে ৯৫০ বর্গফুট আয়তনের পাকা, আধা পাকা ও কাঁচা বাসার ভাড়া হবে যথাক্রমে ৩৩২৫ থেকে ১৭১০০ টাকা, ২৩৭৫ থেকে ৯৫০০ টাকা এবং ১৯০০ থেকে ৮৫৫০ টাকা, যা মোটেও অনুসৃত হয় না। বাড়িভাড়া নির্ধারণের দায়িত্বও সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়নি। কে ঠিক করবে তা-ও আইনে নির্দিষ্ট করা হয়নি।

ব্যাপারটা হলো, বাড়ি নির্মাণে ব্যয়, জমির মূল্য এবং ভাড়াটের সক্ষমতা বিবেচনায় যৌক্তিক ভাড়ার হার নির্ধারণ করতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ পরিমার্জন করতে হবে। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১ জুলাই দেশের উচ্চ আদালত ভাড়াটেদের সুরক্ষা দিতে সরকারকে কতিপয় নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আদালতের রায়ে ছয় মাসের মধ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিশন গঠন এবং অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ে পুলিশকে ভাড়া-সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযোগ দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করতে বলা হয়েছিল। জানা যায়, রায় প্রদানকারী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি গত বছর মারা যাওয়ার কারণে বিষয়টি থেমে গেছে।

বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা, তাঁদের মধ্যে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক স্থাপন এবং এই খাতে গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কতিপয় বিষয় বিবেচনা করা দরকার: চুক্তিনামা ও ব্যাংকের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ বাধ্যতামূলক করে বাড়িভাড়ার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান; প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে ভাড়া নিয়ন্ত্রকসহ একটি সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাড়িভাড়া বিষয়াবলি দেখভাল করার দায়িত্ব অর্পণ; গণশুনানি করে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়ার হার নির্ধারণ, জনসমক্ষে প্রকাশ ও বহুল প্রচার এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভাড়ার হার হালনাগাদ এবং বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের দায়িত্ব, অধিকার ও অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ ’কে হালনাগাদ করা।

সব শেষে, গৃহকর বাড়ানোর আগে এর প্রভাব সম্পর্কে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। করের হার না বাড়িয়ে যাঁরা এখনো গৃহকর দেন না বা কম কর দেন, তাঁদের করের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। ব্যাংকের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করা গেলে গৃহকর আদায়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে। করপোরেশনের অধীন সব বাড়ির ওপর জরিপ চালানো এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গৃহকর হালনাগাদ করা উচিত।

মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম: নগরবিষয়ক গবেষক ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। 
[email protected]