এখন সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠ সময়

তোরি পেদেরসেন
তোরি পেদেরসেন
তোরি পেদেরসেন নরওয়ের শিবস্তেদ মিডিয়ার সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। শিবস্তেদ মিডিয়া গ্রুপ একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া গ্রুপ; সুইডেন ও নরওয়ের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্র এই গ্রুপের মালিকানাধীন। এটি পৃথিবীর প্রথম সারির শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোরও অন্যতম, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার ২২টি দেশে এর কর্মকাণ্ড রয়েছে। তোরি পেদেরসেন সম্প্রতি ঢাকা সফরে এলে প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁর সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা, ভুয়া খবরের প্রাদুর্ভাব, মুদ্রিত ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের গতি-প্রকৃতিসহ নানা বিষয়ে আলাপ হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলমআয়েশা কবির


প্রথম আলো:
বৈশ্বিকভাবে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা কী?

তোরি পেদেরসেন: বলা যেতে পারে, সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব কী, সে সম্পর্কে ধারণার একধরনের পুনর্জন্মের সময় চলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই তিনি ভুয়া খবরের কথা বলে চলেছেন, আর আপনারা যদি নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট পড়েন, তাহলে দেখবেন পত্রিকা দুটি একটার পর একটা বিশেষ খবর (স্কুপ) ছাপছে। সুসাংবাদিকতার ধারণার ব্যাপারে জনগণ সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম কী ভূমিকা পালন করে, সে সম্পর্কে জনসাধারণের বিরাট অংশের ধারণা আরও গভীর হচ্ছে। অন্যদিকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম জনগণের সব অভিজ্ঞতা ও উদ্বেগের কথা লিখছে না। যেমন, ট্রাম্পের নির্বাচনের সময় অভিবাসন ছিল খুব একটা বড় বিষয়। যদিও বিশ্বায়নের ফলে মানবজাতি মোটের ওপর উপকৃত হয়েছে, তবু শিল্পোন্নত দেশগুলোর কিছু মানুষ পিছিয়ে পড়েছে, কারণ সেসব দেশ থেকে অনেক কলকারখানা বাংলাদেশ বা অন্য দেশগুলোতে চলে গেছে। ওই সব দেশের কিছু মানুষ অবহেলিত বোধ করছে, যা রাজনীতিকেরা উপলব্ধি করেন না। এমনকি মূলধারার সংবাদমাধ্যমও এই বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়নি, কারণ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু অন্যান্য পেশার মানুষের ক্ষেত্রে হয়তো সেটা ঘটছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও আমেরিকায় বৃহৎ সংবাদমাধ্যম একটা সাময়িক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।

প্রথম আলো: বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে?

তোরি পেদেরসেন: প্রধান চ্যালেঞ্জ একটা টেকসই ব্যবসায়িক মডেল দাঁড় করানো। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের একটা খুব ভালো ব্যবসায়িক মডেল ছিল: পাঠক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে অর্থ আসত। এখন সেটা ডিজিটাল ক্ষেত্রে স্থানান্তর হয়ে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে। এখনকার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো টেকসই ব্যবসায়িক মডেল। কারণ, সুসাংবাদিকতা ব্যয়বহুল।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য আয়ের বিষয়টা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনারা আপনাদের অনলাইন সংবাদমাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান কীভাবে করেছেন?

তোরি পেদেরসেন: আমি বলব না যে আমরা এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি আর আপনারাও যেসব সমস্যার মুখোমুখি, সেগুলো বিস্ময়করভাবে একই রকমের। শুধু একটা পার্থক্য হলো, আপনারা কয়েক বছর পিছিয়ে আছেন। আপনাদের দেশে মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা সম্ভবত দুই-তিন বছর আগেও বাড়ছিল, কিন্তু আমাদের দেশে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে ১৫ বছর আগে। বাংলাদেশে নিশ্চয়ই এখনো সুযোগ আছে, কারণ আপনাদের লোকসংখ্যা অনেক বেশি, বছর বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটছে। আপনারা আরও পাঠক, আরও বিজ্ঞাপনদাতাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবেন। আয় এখন বাড়ছে, কিন্তু তা শুরু হয়েছে খুব অল্প দিয়ে। পার্থক্যটা হলো, মানুষ ছাপা সংবাদপত্র পড়ে নগদ টাকা দিয়ে কিনে, অনলাইনে পড়ার জন্য টাকা খরচ করতে হয় না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞাপন থেকেও আয় করতে হবে, পাঠকের কাছ থেকেও কোনো না কোনোভাবে অর্থ পেতে হবে। আজকেই অনলাইন থেকে বেশি আয় আশা করা যাবে না, তবে শুরু করতে হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে, পথ খুঁজে পেতে হবে। পাঠককে আগামীকাল থেকেই অনলাইনে পড়ার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে না, তবে বিশেষ আগ্রহের বিষয়গুলো পড়ার জন্য কিছু অর্থ ব্যয় করতে তাঁদের প্রস্তুত করে তুলতে হবে।

প্রথম আলো: অনলাইনের বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে গুগল, ফেসবুক, টুইটার, আমাজন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কাছে, যারা সাংবাদিকতা করে না। এ সমস্যা সমাধানের উপায় কী?

তোরি পেদেরসেন: এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমার জানা থাকত, তাহলে আমি একজন কোটিপতি হতাম। সবাই এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। আমরা একটা রূপান্তরের পর্যায়ে আছি। তবে আমি মনে করি না যে আমরাই শেষ প্রজন্ম, যারা সাংবাদিকতার গুরুত্ব উপলব্ধি করি। ভবিষ্যতেও এটা পরিষ্কারই থাকবে যে গণতন্ত্রের জন্য সাংবাদিকতা একটা মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হয়তো কিছু সমাধান পাওয়া যাবে, আইনগত নিয়ন্ত্রণের মতো কিছু। মানুষের আচরণেও পরিবর্তন আসতে পারে। আমি নিশ্চিত নই যে আজ থেকে ১০ বছর পরও ফেসবুক এত বড় ব্যাপার থাকবে। পরিবর্তন সব সময়ই ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপলের আইপড আসার আগে সনি কোম্পানি ওয়াকম্যান বিক্রি করত। আইপড আসার পর ওয়াকম্যান বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

প্রথম আলো: বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কী?

তোরি পেদেরসেন: বিভিন্ন মহাদেশে বিভিন্ন রকম। পার্থক্যটা খুবই বড়। স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যম খুবই দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে, কারণ এই দেশগুলো প্রযুক্তিগতভাবে খুবই অগ্রসর। যারা বাজারে আসছে, তাদের প্রত্যেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সুদক্ষ। মুদ্রিত মাধ্যমের ক্ষেত্রে বাজারে বাজারে বিরাট পার্থক্য আছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে অল্প সময় আগেও ছাপা সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা বাড়ছিল। ভারত ও বাংলাদেশে শিক্ষার হার ক্রমেই বাড়ছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। সুতরাং মুদ্রিত সংবাদপত্রের বাজার এখনো আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের সংবাদ পাঠ ও সংবাদ প্রচারের পদ্ধতিটাই বদলে দেবে।

প্রথম আলো: অনলাইন সাংবাদিকতার যুগে সাংবাদিকদের নিজেদেরও কি অনেক কিছু বদলাতে হয়েছে?

তোরি পেদেরসেন: আমাদের এখন আর পৃথক মুদ্রণ বিভাগ নেই; শুধু রাতের বেলা সংবাদপত্রের পাতা সাজান, নকশা দেখেন এ রকম কিছু কর্মী আছেন। যাঁরা প্রতিবেদন লেখেন, তাঁদের জানানো হয়, তাঁদের প্রতিবেদন কোন মাধ্যমে যাবে, ছাপা হবে, নাকি অনলাইন সংস্করণে যাবে, নাকি অন্য কোনো চ্যানেলে যাবে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের শিখতে হবে প্রতিদিনের অনুশীলনের মাধ্যমে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ এভাবেই শেখে। এটা তো রকেটবিদ্যা নয়। আমি খুবই বিশ্বাস করি, একজন ভালো সাংবাদিক ডিজিটাল মাধ্যমেও ভালো করবেন। আজকে যে সাংবাদিকতা আমি দেখছি, তা আমার জীবনে দেখা সেরা সাংবাদিকতা। আজকের সাংবাদিকেরা আমাদের সামনে সংবাদ উপস্থাপন করছেন চমৎকার নানা পদ্ধতিতে, তাঁরা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, ভিডিও, অ্যানিমেশন ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। আমি সংবাদের গভীরে যেতে পারি, আবার বেশি গভীরে না-ও যেতে পারি। আজকে যিনি সেরা সাংবাদিক, তিনি এযাবৎকালের সেরা সাংবাদিক।

প্রথম আলো: মূলধারার সংবাদমাধ্যমের আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেখানে তথ্য, খবর, অভিমত, গুজব, ভুয়া খবর-সব পাওয়া যায়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উপায় কী?

তোরি পেদেরসেন: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এ ব্যাপারে অনেক মানুষের জন্য ছিল একটা জেগে ওঠার ডাক। প্রচুর ভুয়া খবর, মিথ্যা সমালোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে বিদেশ থেকে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা, শুধু একটা দেশ থেকে নয়, সম্ভবত অনেক দেশ থেকেই এ রকম করার চেষ্টা হবে। বাংলাদেশে যখন নির্বাচন আসবে, তখন সেখানেও সে রকম কিছু ঘটতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কিছুটা সরল, কারণ তাদের যে গাঠনিক মডেল, তাতে তারা তাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে মোটেও পরিষ্কার ধারণা রাখে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন ভুয়া খবর থাকে, তেমনি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও পাওয়া যায়। সম্প্রতি এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে যে এ বিষয়ে কী করা যায়। আমার অনুমান, রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার ক্ষেত্রে এই বিতর্ক বাড়তেই থাকবে, কারণ আমরা এই ব্যবস্থার দ্বারা গণতন্ত্রের ক্ষতি মেনে নিতে পারি না।

প্রথম আলো: আপনি এ পর্যন্ত যা দেখলেন, তাতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

তোরি পেদেরসেন: বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মূল্যায়ন করার মতো অবস্থানে আমি নেই। এখানকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করার অবস্থানেও আমি নেই, কারণ আমি এই সমাজে বাস করি না। তবে আমি যেটুকু দেখলাম, তাতে মনে হলো, আমাদের কিছু বিস্ময়কর মিল আছে। আপনাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাও একই। আপনারা সমাজের কল্যাণ করতে চান। এটা সাংবাদিকদের প্রণোদনা। আপনারা হয়তো পুরো সমাজটাকে বদলাতে পারেন না, কিন্তু মানুষের জন্য আপনার বিশ্বটাকে আরেকটু ভালো করতে পারেন। এই আকাঙ্ক্ষা আমি এখানেও দেখেছি। এখানে সেটা করার বিরাট সুযোগও আছে, কারণ আপনাদের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি বা তারও বেশি। এখানে শিক্ষার হার ক্রমেই বাড়ছে, আয় ক্রমেই বাড়ছে। সুতরাং প্রকৃত সাংবাদিকতার অনুকূল পরিবেশ থাকলে আপনাদের সামনে অনেক সুযোগ অপেক্ষা করছে।

প্রথম আলো: আপনি কি বাংলাদেশে এসে সাংবাদিকতার ওপর কোনো চাপ টের পেয়েছেন?

তোরি পেদেরসেন: আমি শুনেছি, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশনের সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপের কথাও শুনেছি। ইউরোপে এই অভিজ্ঞতা হচ্ছে তুরস্কে। তুরস্কের সংবাদমাধ্যমে এখন ব্যাপক সেলফ সেন্সরশিপ চলছে, সে দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বড় বড় কোম্পানিকে বিজ্ঞাপন না দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। পোল্যান্ড আর হাঙ্গেরিতেও এ রকম ঘটছে, সেখানে অধিকতর ডানপন্থী দলগুলো এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। বাংলাদেশে আমার সে রকম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তবে আমি এ ধরনের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছি। এর মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন এগিয়ে আসছে, সুতরাং দেখা যাক। আমার চেয়ে আপনারাই ভালো জানেন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে কিছু বলুন।

তোরি পেদেরসেন: দুই দিনের সফরে আমার মনে হয়েছে, আপনারা সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে অবগত। শুধু আপনারাই সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেন। বাইরে থেকে কেউ এসে আপনাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে দিতে পারবে না। আপনাদের দক্ষতা, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতার দ্বারাই সেটা হবে। সবাই মিলে একত্রে কাজ করার মনোভাব থাকলে আপনাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোরি পেদেরসেন: ধন্যবাদ।

এই সাক্ষাৎকারের সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষ্য পড়ুন:‘Journalism paramount, fundamental for democracy’