মোনাজাতউদ্দিন যদি ফিরে এসে প্রশ্ন করেন

মোনাজাতউদ্দিন
মোনাজাতউদ্দিন

‘যারা ভোটের সময় ভোট নেয়/ কিন্তু তারপর মানুষের কাছ থেকে/ দূরে সরে যায়,/ তাদের জন্যে আমার/ সমস্ত ঘৃণা।/ যারা মানুষের উন্নয়নের কথা/ বলে, কিন্তু ক্ষমতায় যাবার পর/ নিজের সম্পদ গড়ে,/ তাদের জন্যে আমার/ সমস্ত ধিক্কার।’ ‘চিলমারীর একযুগ’ বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি ওপরের লাইন কটি লিখেছেন। তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত টানা চিলমারীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যে প্রশ্নগুলো সেদিন তিনি তুলেছিলেন, সেগুলো আজ নির্মমভাবে প্রাসঙ্গিক। কুড়িগ্রামের ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের শীর্ষে থাকা প্রমাণ করে যে দিন বদলায় নাই। বদলেছে নেতাদের নাম, কিন্তু মানুষ রয়ে গেছে আগের মতোই।

আমাদের গণমাধ্যম জগৎ কাগজ অতিক্রম করে ডিজিটাল হয়েছে কবেই, গ্রাম পর্যন্ত চলে গেছে পিচের পথ। কিন্তু সংবাদকর্মীরা জনগণ পর্যন্ত যেতে পেরেছেন কি? সমীক্ষা বলছে, জনগণের একটা অংশ তো গণমাধ্যমকে বিশ্বাসই করে না আর। কিন্তু মোনাজাতউদ্দিন শুরুই করেছিলেন কৃষক, কৃষিব্যবস্থা ও কৃষি প্রশাসন নিয়ে। কৃষক থেকে বিচ্ছিন্ন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ভুয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যেমন কৃষিনীতি গড়ে তোলে, তেমনি নীতিনির্ধারকেরা বারবার বিদেশ ঘুরে এলেও চিলমারীর মতো প্রত্যন্ত এলাকা জীবনে একবারও না ঘুরে এর সম্পর্কে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বসেন। তার ফল যা হওয়ার তা-ই হয়। তাই মোনাজাতউদ্দিনের লেখার শিরোনাম হয়: কৃষকের সাথে অপরিচয়ের দৈন্য ঘোচাতে হবে। তিনি আরেকটি উপসম্পাদকীয়তে লেখেন: ‘আমাদের ভালো জিনিসের চাহিদা বা প্রয়োজন না মিটলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। বাজারের ভালো মাছটি কিনতে না পারলে মন খারাপ হয়ে যায়, খুব দামি না হলেও মাঝারি দামের ভালো শার্ট কিনতে অপারগ হলে দু’চোখে অন্ধকার দেখি, সাদা-কালো থাকলে চাই রঙিন টেলিভিশন ভিসিআর, রঙিন টেলিভিশন থাকলে ডিশ—এসব জোটাতে না পারলে জীবনটা ব্যর্থ মনে হয়; চাইনিজ রেস্তোরাঁর রঙিন আলোর সামনে দিয়ে যেতে যেতে আমরা যাঁরা সেখানে ঢুঁকতে পারিনে, তাঁদের মনের মধ্যে খচখচ করে। সুতরাং আমাদের অবস্থানে থেকে রংপুর-চিলমারীর দুঃখ-দুর্দশা পরিমাপ করা কঠিন।’

অর্থাৎ তিনি সিদ্ধান্ত টেনেছেন, কাদের পক্ষে রংপুর-চিলমারীর দুঃখ-দুর্দশা পরিমাপ করা সম্ভব। বলেছেন, এই দরিদ্র দেশটিতে কে কতটা রাজা-মহারাজার জীবনযাপন করবে বা করা সংগত, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবু আপাতত এই হতদরিদ্র জীবনের বিষয়টাই উল্লেখ করা যাক। দেশে এত কিছু উন্নতি-উন্নয়নের পরও বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ শতকের এই শেষ ভাগে একটা অঞ্চলে গাছআলু, কলার থোড় মানুষের ক্ষুধার খাদ্য। এই লোকগুলো যদি আমাদের শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন, রাজধানীর ডাবল কার্পেটিং রাজপথ, ঝলমলে নিওন আলো, চোখধাঁধানো বিপণিকেন্দ্র আর এত সব মূল্যবোধের বাগাড়ম্বর নিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে তাদের কাছে আমাদের উত্তর কী হবে?

২.
মোনাজাতউদ্দিন বেঁচে নেই! তিনি যদি জানতেন বছরে লক্ষ-কোটি টাকা পাচার হবে আর বিদেশে তথা ইউরোপ-আমেরিকায় সেকেন্ড হোমের কথা; আর যদি জানতেন, চিলমারী থেকে যাবে তাঁর দেখা এক যুগের চিলমারীর অবস্থাতেই! চিলমারীর মানুষ ভবিষ্যতে ব্রহ্মপুত্রের মাছটুকুও খেতে পারবে না, এ তথ্য না জেনেই তিনি মরে বেঁচে গেছেন।

আজ উন্নয়ন আর গণতন্ত্র সমার্থকতার যুগ। সেই যুগে তিনি এই উন্নয়নকে প্রশ্ন করেছেন: ‘গোটা দেশের উন্নয়ন বলতে কি থানা সদর কেন্দ্র কিংবা আশপাশের দু-একটি ইউনিয়নের পাকা সড়ক আর বিদ্যূৎ সম্প্রসারণ? ইউনিয়ন মানে কি থানায় কলেজ প্রতিষ্ঠা আর প্রায় যোগাযোগবিহীন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন? থানা প্রশাসনিক ভবনের চাকচিক্য, নতুন নতুন মোটরসাইকেলের আমদানি, সিনেমা হল? কিছু নতুন টিভি সেটের এন্টেনা? উন্নয়নের নামে চিলমারীতে এক যুগে এ-ই হয়েছে। অথচ হয়নি কোন শিল্পকারখানা। হয়নি একটি হিমাগার। এই অঞ্চলের নিম্নমানের পাট দিয়ে দড়ি-সুতলির কারখানা হতে পারে, বিভিন্ন কৃষিপণ্যভিত্তিক ছোট ছোট কারখানা হতে পারে, এসব হয়নি।’

হয়নি বলে সর্বশেষ খানা জরিপমতে ৭৭ শতাংশ গরিব মানুষের বাস চিলমারীতে। হয়নি বলেই কুড়িটি নদ-নদীর জেলাবাসী সবচেয়ে কম মাছ খেতে পায়। গবেষণা রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার এই জনপদের মানুষ। আর সে কারণেই দিনের পর দিন খর্বকায় হচ্ছে চিলমারীর শিশু-কিশোরেরা। তিনি সেই যুগে দেখেছিলেন, চিলমারীর থানাহাট বাজারের পানের দোকানদার হামিদ আত্মীয়ের কাছ থেকে শতকরা ৫ টাকা মাসিক সুদে ১২০০ টাকায় ১০০টি ১০ টাকার লটারির টিকেট কিনেছেন ১২ টাকা দরে কুড়িগ্রামে লোক পাঠিয়ে। আজ আরও বেশি লোক সেই লটারির দিকে চেয়ে আছে। বাস্তব জীবনে যখন মানুষ হাতড়ায়ে হাতড়ায়ে পায় না, তখন অবাস্তবতার পথে যাওয়া ছাড়া উপায় কী! মোনাজাতউদ্দিনের যুগে চিলমারীতে যে পত্রিকাটি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হত, তার নাম ‘একতা’। এখন এক কপিও হয় না। তার মানে, সেই সময়ের প্রতিরোধ খসে পড়েছে। তবু, ঋত্বিক ঘটকের সেই ‘নাগরিক’ সিনেমার পিতার মতো, কুড়িগ্রামবাসীও বহুবার লটারি কাটলেও তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন: লটারি নয়, সংগ্রাম ও চেষ্টা দিয়েই নতুন যুগ আনতে হয়। গত ১৮ জানুয়ারি ছিল মোনাজাতউদ্দিনের জন্মদিন, তাঁর জন্মদিন সেই নতুন যুগেই কেবল সার্থক হতে পারে!

লেখক: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]