রংপুর থেকে ঢাকা কত দূর

সম্প্রতি একজন চিকিৎসক ঢাকায় যাওয়ার জন্য রাত ১১টার বাসে রংপুর থেকে রওনা করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, দিনে অফিসের কাজ শেষ করে রাতে একটি বিয়ের দাওয়াত খেয়ে ফিরবেন। যখন তিনি ঢাকায় পৌঁছালেন, ততক্ষণে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, অফিসের কাজ তো দূরের কথা। তিনি ৬-৭ ঘণ্টার পথ পৌঁছান ২৪ ঘণ্টায়। এই গল্প আমাদের সহকর্মী রাসেলের কাছে করছিলাম। শুনে তিনি বললেন, ‘আমি তো ২৫ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে রংপুরে এসেছি।’

আরেকজন বলছিলেন, সিরাজগঞ্জে ফুড ভিলেজ রেস্টুরেন্টে বিরতি শেষে রাত দেড়টায় বাস ছাড়ার পর তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম যখন ভাঙে, তখন সকাল। তিনি ভেবেছিলেন, ঢাকায় পৌঁছেছেন। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে দেখেন ফুড ভিলেজের সাইনবোর্ড দেখা যায়। সড়কও যেমন খারাপ, তেমনি গাড়ির নিয়ন্ত্রণও নেই। দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলার মানুষের জন্য ঢাকায় যাওয়া এখন অনেকটা শাস্তির মতো।

সড়কপথে যখন ঢাকায় যাওয়ার এমন বেহাল দশা, তখন অনেকেই রেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই রেলব্যবস্থারও চরম বেহাল অবস্থা। ঢাকা থকে রংপুরের একটি মাত্র ট্রেন রংপুর এক্সপ্রেস। চালু হওয়ার পর এই ট্রেনের এতটা বেহাল দশা আগে কখনোই ছিল না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় রেললাইন খুলে রাখা, আগুন দেওয়ার সময়েও এত অব্যবস্থাপনা ছিল না। রাত আটটার ট্রেন এখন কোনো কোনো দিন ছাড়ছে সকাল আটটায়। রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক ওয়াদুদ আলী বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করে রংপুর এক্সপ্রেস এনেছি। আরও একটি ট্রেন দেওয়ার আশ্বাস ছিল, তা পাইনি। তাই আবার আন্দোলনে যাচ্ছি। যে ট্রেনটি পেয়েছি, তা-ও ঠিকমতো চলছে না।’

গত মাসে ট্রেনে ঢাকা গিয়েছিলাম। রোববার রংপুর এক্সপ্রেসের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। সাধারণত বন্ধ থাকার পরদিন ট্রেন যথাসময়ে আসার কথা। সোমবার ৮টায় যে ট্রেন রংপুর থেকে ছাড়ার কথা, সেই ট্রেন রংপুরে এল রাত ১১টায়। রংপুর থেকে ট্রেন ছাড়ে রাত দেড়টায়। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বয়স্ক আবদুস সাত্তার। জিজ্ঞাসা করেছিলাম কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘আটটা থাকি বসি আছি। শরীল খারাপের জন্য ট্রেনোত যাবার আচ্ছি। বসি থাকতে আরও অসুস্থ হইনোং।’ কথা বলে জানলাম, এসএমএসে ট্রেনের সময় জানার পদ্ধতি তিনি জানেন না।

কেন ট্রেন বিলম্ব, তা জানার খুব চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো সদুত্তর মেলে না। ট্রেনের পরিচালক আবদুল মজিদকে জিজ্ঞাসা করি। অনেক জোড়াতালি দেওয়া গল্প বলার চেষ্টা করেন। শেষে বলেন, ‘অনেক পুরোনো ট্রেন তো, নানান অসুবিধা দেখা দেয়। অন্য রুটে চলার পর যখন অচল হয়, তখন এই ট্রেনগুলো রংপুরে দেয়।’ বগিগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। শীতের রাতে জানালা বন্ধ করা যাচ্ছে না। হুহু করে শীত ঢুকছে। পরিচালক নিজেও খুব টানাটানি করেও জানালা বন্ধ করতে পারলেন না। অনেক সিট সোজা থাকছে না। ট্রেনটি ভালোভাবে পরিষ্কারও করা হয় না। টয়লেটও অপরিষ্কার। গাড়ির পরিচালকের কাছে অভিযোগ বই চাইলে তিনি জানালেন, বই শেষ হয়ে গেছে। 
রংপুর থেকে কম টাকায় যাওয়া রেলযাত্রীদের ওপর অধিক টাকা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রংপুর থেকে ঢাকার টিকিটের মূল্য নেওয়া হয় অনেক বেশি। রেলপথ অনেক ঘুরে যাওয়ার কারণে সময় এবং অর্থ দুটোই বেশি লাগে। আগে তবু শোভন সাধারণ বলে একটি শ্রেণি ছিল, যার টিকিটের মূল্য ছিল ৪৩০ টাকা। সেই শ্রেণি তুলে দিয়ে এখন সর্বনিম্ন মূল্যের টিকিট ৫০৫ টাকা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে রংপুরের বাস ভাড়া এবং ট্রেন ভাড়া সমান করার মধ্য দিয়ে রেলযাত্রীদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ সরকার ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২৭০টি বগি আমদানি করেছে। রংপুরের জন্য সেই বগি পাওয়া যাবে না বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা সত্যি হয়েছে।

লাল-সবুজ বগি রংপুর এক্সপ্রেসে যুক্ত হয়নি। অন্যান্য রুটে চলতে চলতে যখন জীর্ণশীর্ণ হবে, তখন হয়তো রংপুরে দেওয়া হবে। এক অর্থে ঠিকই আছে। সাধারণত ধনীরা নিজেদের পোশাক কিংবা অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র পুরোনো হলে গরিবদের দান করে।

রংপুর তো বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব বিভাগ। সে জন্য হয়তো সরকার ধনী বিভাগে চলার পর পুরোনো হলেই সেই ট্রেন রংপুরে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় চালু করেছে, তা বোধ করি রংপুরের রেলের উন্নয়নের জন্য নয়। তা নাহলে দেশে রেলমন্ত্রী থাকতে রেলের এত বেহাল অবস্থা হয় কী করে?

সড়কপথে রংপুর থেকে এখন অধিকাংশ দিনই ১৫ ঘণ্টার অধিক প্রয়োজন হচ্ছে। যেহেতু যথাসময়ে বাস এসে পৌঁছায় না, তাই যথাসময়ে বাস ছাড়েও না। দেশে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে এককথায় যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চার লেন সড়কের কাজের দোহাই দিয়ে বাসের এত সময় লাগানোর বিষয়টিকে যৌক্তিক করে তোলার কোনো উপায় নেই।

আকাশপথের যোগাযোগও ভালো নয়। কোনো দিন শোনা যাচ্ছে, বিমানের চাকা পাংচার হয়েছে। কোনো দিন বিমানের চাকা খুলে গেছে। তা ছাড়া, বিমানের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি ভাড়ায় চলছে বিমান। রংপুর বিভাগের একমাত্র বিমানবন্দরটিও রংপুর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে নীলফামারীর সৈয়দপুরে। রংপুরের কাছেই একটি বিমানবন্দর খুবই জরুরি।

আমাদের ঐতিহ্যবাহী নৌপথ আমরা ধ্বংস করেছি। তা নাহলে উত্তরাঞ্চল থেকে অন্তত দ্রুত অপচনশীল সব পণ্যই নৌপথে পরিবহন করা যেত। এতে সড়কপথের ওপর চাপ কমে আসত, ব্যয় সাশ্রয় হতো।

দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা, তথা সারা দেশের সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন এখন বঙ্গবন্ধু সেতু। কোনো কারণে বঙ্গবন্ধু সেতু কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখতে হলে যে বিপর্যয় নেমে আসবে, তা অকল্পনীয়। সে জন্য গাইবান্ধার ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ কিংবা কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর আরেকটি সেতু স্থাপন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

দেশের যোগাযোগব্যবস্থা দেখভাল করার জন্য কয়েকজন মন্ত্রী আছেন। রেলপথমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী। এই চার মন্ত্রণালয়ের কোনো মন্ত্রী রংপুরের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কাজে আসছেন না। সবচেয়ে গরিব বিভাগ বলে খ্যাত রংপুরের যোগাযোগব্যবস্থার কি উন্নয়ন হবে না?

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। 
[email protected]