আমেরিকায় অভিবাসন এবং সরকার বন্ধের রাজনীতি

স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে ঝুলছিল সাইনবোর্ড—সরকার বন্ধ! সারা পৃথিবীর ক্লান্ত, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে আমেরিকায় স্বাগত জানানোর প্রতীকে এভাবে সরকার-বন্ধের খবর ঝুলে থাকাটিতে কিছুটা কাব্যিক মাহাত্ম্য রয়েছে। কেননা আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে মূল বিতর্কটি ঠিক এই আমেরিকার উন্মুক্ততা অথবা অভিবাসন নিয়ে। সেই উন্মুক্ততার বিতর্কে কংগ্রেসের দুই দল সহমতে পৌঁছাতে না পারার কারণেই ২০১৩ সালের পর আবারও আমেরিকার সরকারি দপ্তরগুলোতে তালা পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খসড়া বাজেট এবং আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী রিপাবলিকানরা সিনেটে যে বাজেট প্রস্তাব করেছে, তাতে পাস হওয়ার মতো যথেষ্ট ভোট পড়েনি শেষ দিনেও। অর্থাৎ সরকার কেমন করে করের ডলার খরচ করবে, তা জানা নেই কারও। সে কারণে সরকারের দপ্তরগুলো এখন হয় গত বছরের ডলারে চলবে অথবা আপাতত বন্ধ থাকবে।

এই অচলাবস্থার মূল উৎস হলো রাজনীতিবিদদের স্বার্থবাদী গোঁয়ার্তুমি। আর সেই গোঁয়ার্তুমির উৎস হলো ডিফার্ড অ্যাকশন অন চাইল্ডহুড অ্যারাইভাল বা ডাকা। ডেমোক্র্যাটরা কোনো মূল্যেই ৭০ হাজার কাগজবিহীন অভিবাসী সন্তানের প্রতি সরকারের দেওয়া সুরক্ষা সরিয়ে নিতে রাজি নয়। আগামী মার্চ মাসেই ডাকার মেয়াদ ফুরাবে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অকূল পাথারে পড়বে কাগজবিহীন অভিবাসীদের সন্তানেরা। এরা কিনা ওবামা সরকারের আশ্বাসের ওপর ভর করে নিজেদের বৈধতার কাগজপত্র না থাকার কথা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সরকারের ক্ষমতা এক দলের থেকে আরেক দলের কাছে যাওয়ায় এবং তাদের পরিচয় প্রকাশের সুযোগ নিয়ে আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার উপক্রম করছে ট্রাম্পপন্থী রিপাবলিকানরা। গাছে তুলে মই সরিয়ে নেওয়ার এই বুদ্ধিতে রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেই অনেকের মত নেই। তাদের অনেকেই এ বিষয়ে দর-কষাকষি করতে প্রস্তুত ছিল, তবে প্রথমে তারা সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাবটি নিকেশ করে নিতে চাইছিল। কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের তর সইল না। সবাইকে জোর করে আলোচনায় বসতে বাধ্য করার জন্য আর সেই আলোচনায় একটি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতেই ডেমোক্র্যাটরা এবার এই খরচের হিসাবে এসে গোঁয়ার্তুমিটা করছে। আটকে গেছে স্পেন্ডিং বিল, বন্ধ হয়ে পড়েছে ফেডারেল সরকার। এখন যদি ডাকার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হয়, তাহলে বন্ধ থাকবে আমেরিকার ফেডারেল সরকার।

রিপাবলিকানদের আরও গোঁয়ার্তুমি রয়েছে ট্রাম্পের বিখ্যাত সীমানাপ্রাচীরের ফান্ডিং নিয়ে আর চেইন মাইগ্রেশন বা একজন নাগরিকের হাত ধরে তার আত্মীয়স্বজনের অভিবাসনের বিরোধিতা নিয়ে। সীমানা টপকানো আর আত্মীয়ের হাত ধরে আসা অভিবাসীদের রিপাবলিকানদের শত্রু হিসেবেও দেখছে অনেকে। যেহেতু রিপাবলিকানরা কেবল সীমানা বুজিয়ে দেওয়া আর কাগজহীন অভিবাসীদের বের করে দেওয়া নিয়ে কথা বলে, সেহেতু অভিবাসীদের সন্তানেরা সাধারণত রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্র্যাটদের বেশি ভোট দেয়। কাগজহীন অভিবাসীদের আমেরিকার মাটিতে জায়গা করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে রিপাবলিকানরা তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অভিসন্ধি হিসেবে দেখে। তা ছাড়া অনেক উগ্রপন্থী রিপাবলিকানের অভিযোগ হলো, চেইন ইমিগ্রেশন অথবা কাগজবিহীন অভিবাসনে আসা মানুষ হিংস্র ও জঙ্গিবাদী। অনেকে মনে করে যে অভিবাসীরা আমেরিকানদের কাছ থেকে চাকরি কেড়ে নিচ্ছে। অথচ কেটো ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে দেখা যায় যে অভিবাসীরা আমেরিকানদের তুলনায় অনেক কম অপরাধপ্রবণ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা এমন সব চাকরিই করে, যেগুলো আমেরিকানরা সাধারণত করতে চায় না।

তা সত্ত্বেও রিপাবলিকানদের মতো ডেমোক্র্যাটরাও আমেরিকার সীমানার উন্মুক্ততার বিরোধী। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সরকারই ইতিহাসে সর্বোচ্চ কাগজবিহীন অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে তাড়িয়েছিল আর বিল ক্লিনটন কাগজবিহীন অভিবাসী তাড়িয়েছিলেন জর্জ বুশের চেয়েও বেশি। রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাট—দুই দলের অধীনেই অভিবাসনের আইন হয়েছে কঠোর থেকে কঠোরতর। এই রক্ষণশীল হুজুগের কারণেই একসময় আইনসম্মত উপায়ে আমেরিকায় প্রবেশ করার চেয়ে বেআইনিভাবে প্রবেশ করাই বেশি যুক্তিসংগত হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, আইনি উপায়ে আমেরিকায় প্রবেশ করতে এবং তারপর কাজ কররার অনুমতি ইত্যাদি খুঁজে নিতে যে পরিমাণ ঝক্কি পোহাতে হয়, তার চেয়ে সীমানা টপকে এ দেশে প্রবেশ করাটাই অনেক বেশি সহজতর। তাই মেক্সিকো এবং তদসংলগ্ন (অনেক ক্ষেত্রে মার্কিনি হস্তক্ষেপের কারণে) অর্থনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো থেকে অনেক সময়ই অনন্যোপায় মানুষ সীমানা টপকে আমেরিকায় চলে আসে সুযোগের সন্ধানে। একসময় সুযোগসন্ধানী ডেমোক্র্যাটরা ভোটব্যাংকের লোভে তাদের নাগরিক বানিয়ে তুলতে আর নাগরিক নিরাপত্তা এবং অপরাপর সরকারি সুযোগ-সুবিধা তাদের হাতে তুলে দিতে উঠে-পড়ে লাগে। আর তাদের দেখে রেগে ওঠে কিছু রক্ষণশীল মানুষ মনে করে যে সারা জীবন ধরে তাদের দেওয়া করের সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে কিছু ভিনদেশী বর্গি! এর সঙ্গে আরও কিছু বর্ণবাদী আদর্শ মিলিয়ে বৈধ-অবৈধনির্বিশেষে সব অভিবাসীকে নিয়ে রে-রে করে ওঠে কিছু উগ্রপন্থী আর তাদের ভোট পাওয়ার লোভে আবারও দুই দল মিলে কঠিনতর করে দেয় আইনসংগতভাবে অভিবাসী হওয়া। বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশের মতো দেশের মানুষের আমেরিকায় টিকে থাকা অথবা নতুন করে আমেরিকান ভিসা পাওয়া।

তবে এই অভিবাসীদের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে আমেরিকার অর্থনীতি। পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, কাগজবিহীন অভিবাসীদের তাড়িয়ে দিলে কৃষি খাতসহ আমেরিকার অর্থনীতির অনেকগুলো খাত ধসে পড়বে। এইআই বলছে, অভিবাসীদের অর্থনীতিতে অবদান জন্মগত আমেরিকানদের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধ অভিবাসনের প্রক্রিয়াকে সহজীকরণের পক্ষে কথা বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বরং উল্টো পথে হাঁটার কথা বলছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর চ্যালাচামুন্ডারা। তাঁরা মেক্সিকো আর আমেরিকার মাঝে দেয়াল তুলে দেবেন, যার পয়সা দেবে নাকি মেক্সিকো। এখন আবার কংগ্রেসে বাজেট করে আমেরিকান করদাতাদের পয়সা দিয়েই দেয়াল বানানোর বুদ্ধি আঁটছেন। সেই পয়সা দিতে গিয়ে আমেরিকার বিশাল বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই বলেই র‍্যান্ড পলসহ আরও কিছু রিপাবলিকান সিনেটরও ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে সঙ্গে ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পপন্থীদের বাজেটের বিপক্ষে এবং শেষ মুহূর্তে ফেডেরাল সরকার বন্ধের গ্যাড়াকলে পড়েছে গোটা আমেরিকা।

স্ট্যাচু অব লিবার্টি অবশ্য খুলে যাবে সোমবার, পয়সা দেবে নিউইয়র্ক স্টেট। স্টেটগুলোর পয়সায় এখনো চলছে আঞ্চলিক পুলিশ, দমকল আর অপরাপর জরুরি সেবা। পুরোনো বাজেটে টিকে রয়েছে এফবিআই, টিএসএ আর কোস্টগার্ডের মতন ফেডেরাল দপ্তরগুলোও। তবে বিপদে রয়েছে শিশুদের স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্প (চিপ), মিলিটারি ডেথ বেনিফিট ফান্ড ও আমেরিকান রিপাবলিকান পার্টি। যদিও ডেমোক্র্যাটদের দোষ কিছুমাত্র কম নয়, তবু সরকার বন্ধের ফলে দায় এসে পড়বে রিপাবলিকানদের ওপরই। ভোটের হিসাবে ষাটটি ভোটের কমে সিনেটে কোনো বিল পাস করা যায় না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও রিপাবলিকানদের হাতে রয়েছে কেবল একান্নটি ভোট। কিন্তু আমেরিকার জনতা সহজ হিসেবে দেখছে যে হাউসে (নিম্নকক্ষে), সিনেটে (উচ্চকক্ষে) আর প্রেসিডেন্সিতেও রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও তারা সরকার খোলা রাখতে আর তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী বাজেট পাস করতে পারেনি।

অর্থাৎ এই মুহূর্তে যদি আমেরিকার দোর বুজে দেওয়ার এই পাগলা নেশা থেকে ট্রাম্প ও তাঁর সহচরীরা বের হতে না পারেন, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন তাঁরা নিজেরাই। আমেরিকার উন্মুক্ততা নিয়ে আপসে আসা আজ রিপাবলিকানদের ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র চাবিকাঠি। যত তাড়াতাড়ি তারা এটি বুঝে উঠতে পারবে, ততটাই সবার জন্য মঙ্গল।

অনুপম দেবাশীষ রায় : গবেষণা সহযোগী, কেটো ইনস্টিটিউট, ওয়াশিংটন ডিসি।