অস্ত্র চুক্তির পথ মসৃণ করাই ছিল উদ্দেশ্য

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স

আপনি যদি এই ধারণা করে থাকেন যে ভারতীয় জনগণ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সর্বজনীনভাবে ভারতে স্বাগত জানিয়েছে, তাহলে আপনার ধারণা ভুল। ভারত ও ইসরায়েল উভয় দেশের করপোরেট সংবাদমাধ্যম নিজ নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আসা প্রেস বিজ্ঞপ্তিগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিল এবং যেভাবে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছিল, তারা সেভাবেই প্রচারণা চালিয়েছে।

নেতানিয়াহু তাঁর সফরের সময় তাজমহল, গান্ধীর সবরমতী আশ্রম ও তাঁর সমাধিস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি একটি প্রযুক্তিকেন্দ্র উদ্বোধন করেন এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। করপোরেট সংবাদমাধ্যম নেতানিয়াহুর ভারত সফরের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তো কিছু জানায়ইনি, উপরন্তু সেই সব ভারতীয়কে উপেক্ষা করেছে, যারা কিনা নেতানিয়াহুর সফরের প্রতিবাদ করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে।

সব ধরনের অনুষ্ঠান ও আড়ম্বরের মধ্যে সংবাদমাধ্যমগুলো এই তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও নেতানিয়াহুর মধ্যে অস্ত্র চুক্তি নিয়ে আলোচনা কোথায় হয়েছে। ভারত হচ্ছে ইসরায়েলি অস্ত্রের বড় ক্রেতা। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভারত যত অস্ত্র কিনেছে, তার ৪১ শতাংশ কিনেছে ইসরায়েলের কাছ থেকে। সংবাদমাধ্যমে যেসব ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সব ব্যবসায়ী নেতার মধ্যে অস্ত্র প্রস্তুতকারক ও অস্ত্রের ঠিকাদারেরাও ছিলেন। নীল স্যুট আর সিল্কের টাই পরে তাঁরা এমন ভান করছিলেন যে তাঁদের ব্যবসা শুধুই ব্যবসা, যুদ্ধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এই বৈঠকে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম কেনাসংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু গত ২ জানুয়ারি ভারত সরকারকে জানানো হয় যে ইসরায়েলি অস্ত্র কোম্পানিগুলো চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র সরবরাহ করবে না। এরপর ওই দিনই মোদি ৫০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি বাতিল করে দেন। ওই বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ইসরায়েলের কাছ থেকে ভারতের ১ হাজার ৬০০টি স্পাইক অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড মিসাইল কেনার কথা ছিল। নেতানিয়াহুর সফরের সময় মোদি বলেন, চুক্তিটি আবার টেবিলে ফিরে গেছে। আসলে মোদি নেতানিয়াহুকে ব্যক্তিগতভাবে বলেন ২ জানুয়ারির নোটিশকে অগ্রাহ্য করতে। এটা করার জন্য মোদিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সামরিক কোম্পানি ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের বিরুদ্ধে যেতে হয়েছে, যা কিনা ভারত সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ শিল্পনীতি অনুসারে কাজ করছিল। ভারতকে এখন অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল বানানোর পরিবর্তে ভারতে ইসরায়েলি প্রযুক্তি আমদানি করতে হবে।

আসলে ভারত ও ইসরায়েলের সম্পর্কের মূলে রয়েছে অস্ত্র। আর বাকি সব গৌণ। তবে এটাই সব নয়; মোদি-নেতানিয়াহু উভয়েই এমন ভাবমূর্তি তৈরি করতে চান যে তাঁরা মহৎ উদ্দেশ্যে দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করতে সচেষ্ট। ১৯৩১ সালে একবার মহাত্মা গান্ধীকে ভারতের সামরিক বাহিনী সম্পর্কে বলতে অনুরোধ করেছিলেন একজন সাংবাদিক।

গান্ধী তখন বলেছিলেন, তিনি আশা করেন যে ভবিষ্যৎ ভারতে থাকবে সবচেয়ে ছোট সেনাবাহিনী। কিন্তু ভারত এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর দেশ (চীনের রয়েছে বৃহত্তম সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তৃতীয়)। ভারত তার সামরিক বাহিনীর পেছনে বছরে ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ব্যয় করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও সৌদি আরবের পর ভারত সামরিক বাহিনীর পেছনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। সৌদি আরবের পর ভারতই সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করে।

নরেন্দ্র মোদি নেতানিয়াহুকে আহমেদাবাদে সবরমতী নদীর তীরে গান্ধীর মূল আশ্রমে নিয়ে যান। এরপর রাজঘাটে গান্ধীর সমাধিস্থলেও নিয়ে যান, যা কিনা গান্ধীর মতো নেতার জন্য অপমানজনক। এটা এ জন্য নয় যে এই সব মানুষ এখানে এসেছেন অস্ত্র চুক্তির পথকে মসৃণ করতে, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।

নেতানিয়াহুর ভারত সফরের সময় করপোরেট সংবাদমাধ্যম ফিলিস্তিনি জনগণের কথা একেবারে ভুলে যায়। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি গান্ধী বরাবরই সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৩৮ সালে গান্ধী লিখেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন আরবের অন্তর্গত। আরবদের ওপর ইহুদিদের চাপিয়ে দেওয়াটা খুবই ভুল এবং অমানবিক।’ ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াইকারী হিসেবে তিনি এগুলো লিখেছিলেন। তাঁর মতে, ইউরোপ ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করতে পারে না।

ইসরায়েল গঠনের দুই বছর আগে ১৯৪৬ সালে গান্ধী লিখেছিলেন, কেন ইহুদিরা আমেরিকার অর্থ আর ব্রিটিশ অস্ত্রের ওপর নির্ভর করছে নিজেদের এমন একটি ভূমিতে ঠেলে দিতে, যেখানে তারা অবাঞ্ছিত? মোদি ও তাঁর সরকার নেতানিয়াহুর এই সফরের সময় ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে গান্ধীর মনোভাব সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করেননি। আসলে তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল অস্ত্র চুক্তির পথকে মসৃণ করা।

নেতানিয়াহুর সফরের প্রতিবাদে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। নয়াদিল্লিতে কমিউনিস্ট আন্দোলন ও ফিলিস্তিনপন্থী গ্রুপগুলো বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্ক্সিস্ট) নেতা প্রকাশ কারাট বলেছেন, নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মোদি সরকার ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন দখলের বৈধতা দিল। তিনি উল্লেখ করেন, এমনকি যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েল সফর করেন, তখন তিনি পশ্চিম তীর গিয়েছেন। কিন্তু যখন মোদি গত গ্রীষ্মে ইসরায়েল সফর করেন, তখন তিনি ফিলিস্তিনকে উপেক্ষা করেন। নেতানিয়াহুর ভারত সফরের সময় ফিলিস্তিনের উল্লেখ না থাকাটা ভারতের রাজনৈতিক চেতনা থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলার নীতিরই একটি অংশ।

ভারত সফরকালে নেতানিয়াহু মুম্বাই যান। সেখানে বলিউডের নামীদামি অভিনেতা, অভিনেত্রী ও প্রযোজকদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেখানে তোলা এক সেলফিতে নেতানিয়াহুর পাশে অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, ঐশ্বরিয়া রাই, বিবেক ওবেরয় এবং প্রযোজক রাজ নায়ক ও রনি স্ক্রুওয়ালাকে দেখা যায়। তাঁরা সবাই তাকিয়ে ছিলেন ক্যামেরার দিকে। দুর্নীতির অভিযোগে যাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, এমন একজন ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য তাঁদের চেহারায় কোনো অনুশোচনার চিহ্ন দেখা যায়নি।

তবে ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের সবাই যে নেতানিয়াহুর এই সফরকে স্বাগত জানিয়েছে, তা নয়। অনেকেই তাঁর সফরের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন পুরস্কার বিজয়ী তথ্যচিত্রনির্মাতা আনন্দ পট্টবর্ধন। তিনি ‘নেতানিয়াহু গো ব্যাক’ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। এই বিক্ষোভ সম্পর্কে জানতে চাইলে আনন্দ বলেছিলেন, খুব জোর সম্ভাবনা আছে যে বলিউডের বড় নামগুলো নেতানিয়াহু-বিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেবে। কারণ, আসলে ভারত ইসরায়েল নয়, ফিলিস্তিনি জনগণের বন্ধু।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রোকেয়া রহমান।

বিজয় প্রসাদ: ভারতীয় সাংবাদিক।