অবৈধ বালু উত্তোলন কতটা ক্ষতিকর?

অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক খবর দেখা যায়। অবৈধ বালু উত্তোলন ক্ষতিকর-এ ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত। কিন্তু তা কতটা ক্ষতিকর বা এর প্রভাব আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে কতটা পড়ছে, তা নিয়ে আরও গুরুতর ভাবনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিশ্বব্যাপী সম্পদ আহরণের ফলে পরিবেশের ওপর উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। তবে কয়লা বা সোনা উত্তোলনের চেয়ে বালু উত্তোলনের নেতিবাচক প্রভাব তুলনামূলক কম। উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই বালু উত্তোলন হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে বালু উত্তোলনের ইতিবাচক দিকও রয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উদ্ভিদ ও প্রাণীর নতুন আবাস ও নতুন জলাধার সৃষ্টিতে এর অবদান রয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনাহীন যত্রতত্র বালু উত্তোলন পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করা হলেও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

পোল্যান্ডের এজিএইচ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির দুজন গবেষক কোভালাস্কা ও সাবজিকের মতে, বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করতে হলে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। এর মধ্যে আছে বালু উত্তোলনের স্থান, আয়তন, সময়, অন্যান্য খনি, সংশ্লিষ্ট এলাকার জীববৈচিত্র্য ও উত্তোলনের প্রাযুক্তিক ব্যবস্থা। কিন্তু এসবের কিছুই বালু উত্তোলনে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এখন পর্যন্ত বালু উত্তোলন চলে ভূমির খাত ও নদীগর্ভ থেকে। এ অবস্থা মাত্রাহীন হয়ে পড়ায় অনেক দেশে আইন করে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সেসব দেশে সামুদ্রিক বালু উত্তোলনের মাত্রা বেড়ে গেছে। সামুদ্রিক বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণেও বেশ কিছু বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের আইন রয়েছে। বৈশ্বিক আইনের মধ্যে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন কনভেনশন (আনক্লজ) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া অনুকরণীয় ও উল্লেখযোগ্য আইনগুলো হলো এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ডিরেক্টিভ এবং যুক্তরাজ্যের ডিপ সি মাইনিং অ্যাক্ট ২০১৪।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ি, রাস্তা, ব্রিজসহ যেকোনো ধরনের কংক্রিট নির্মাণসংক্রান্ত অবকাঠামো সম্পূর্ণ বৈধ বালু দিয়ে করা হয়েছে বলে কেউ দাবি করতে পারবে না। গত বছর মার্চে ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ে গঙ্গা ও যমুনা নদীসহ বাস্তুতন্ত্রকে জীবন্ত মানুষের মর্যাদা দিয়েছেন। ফলে মানুষের যেসব আইনি অধিকার রয়েছে, এসব নদীরও তেমনি আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলনসহ অন্যান্য দূষণ থেকে নদীকে বাঁচাতে এ রায় দেওয়া হয়।

রোমানিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক মারিয়াস ড্যান গ্যাব্রিলেশিয়া বালু উত্তোলন প্রক্রিয়ার পাঁচটি ধাপ উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি ধাপে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয় বলে তিনি মত দেন। ফলে বাস্তুসংস্থানকে আগের অবস্থায় ফেরত আনাটা অনেক ব্যয়বহুল হবে। অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভবও নয়।

পরিবেশের ক্ষতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলে নেতিবাচক পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানি ও বায়ুদূষণ, প্রাকৃতিক ভূচিত্র নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, এসব নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনে সৃষ্ট বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি তাদের খাদ্যের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মৎস্য প্রজনন-প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি চাষাবাদের জমিও নষ্ট হচ্ছে।

বালু উত্তোলনে পানিদূষণসহ নদীগর্ভের গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে। পুরো হাইড্রোলজিক্যাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কাছাকাছি মাটির ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি মাটির গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া নলকূপে পানি পাওয়াও কষ্টকর হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনেও এই বালু উত্তোলনের প্রভাব রয়েছে। উত্তোলন-প্রক্রিয়া ও বালু পরিবহন জলবায়ু পরিবর্তনে সরাসরি ভূমিকা রাখে। আবার সিমেন্ট উৎপাদনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। ২০১৩ সালের হিসাবে দেখা যায়, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের ৫ শতাংশ আসে সিমেন্ট উৎপাদন থেকে।

বাংলাদেশে অবৈধ বালু উত্তোলনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন রয়েছে বলে বহু অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় এর সত্যতাও রয়েছে। অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু আবার জলাশয় অপদখলের অন্যতম পদ্ধতি। এসব বালু দিয়েই দখলের আগে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জলাশয় ভরাট করে থাকেন। গত বছর আবার বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপে প্রতি কিউবিক ফুট বালু এক টাকা দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অবৈধ বালু উত্তোলন আইন করে একেবারে বন্ধও করা যাবে না। তাহলে মাদক ও যৌন ব্যবসার মতো তলে তলে নতুন শিল্প গড়ে উঠবে। ফলে নির্মাণের খরচই শুধু বাড়বে, বালু উত্তোলন বন্ধ হবে না। বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বালু উত্তোলনের নির্ধারিত স্থান করে দেওয়া ছাড়া সমাধান নেই। তবে তা অবশ্যই পরিবেশগত সমীক্ষা করেই নির্ধারণ করতে হবে। এসব নির্ধারিত স্থানে বালু উত্তোলনের চুক্তি করতে হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। এর ফলে বালু ও পাথর উত্তোলনের পরিমাণ যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তেমনি রাজস্বও আদায় করা সম্ভব হবে। ভারতসহ বেশ কয়েকটি দক্ষিণ এশীয় দেশে এ রকম নির্ধারিত স্থানের নদীগর্ভ থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন লাইসেন্সের মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু নির্মাণশিল্পের চাহিদার সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুতরাং সবগুলো দিক বিবেচনা করেই নীতি নির্ধারণ করা উচিত।

অর্থনৈতিকভাবে বর্ধনশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বালু ও পাথর উত্তোলন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। শিল্পায়ন ও নতুন অবকাঠামো নির্মাণে বালু ও পাথর অপরিহার্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বিবেচনায় এই হার ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী ভাবনার বিষয়। জাতিসংঘের হিসাবমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ আরও ২৫০ কোটি মানুষ নগরবাসী হবে। ফলে অবকাঠামো ও নতুন নির্মাণ চাহিদা বাড়ায় বালুর চাহিদাও বাড়বে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় এখন থেকেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

খলিলউল্লাহ্: সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।
[email protected]