ইসি উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারে

ঢাকা উত্তরের নন্দিত মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া পদে উপনির্বাচনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আইনত পদ শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ওই পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের ওপর যে চারটি দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর তিনটিই জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং উপনির্বাচনবিষয়ক। যেমন সংসদ গঠিত হওয়ার নিমিত্তে সংসদ সদস্য নির্বাচন, ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ এবং সংসদীয় আসনের জন্য সীমানা নির্ধারণ করা। এর সঙ্গে চতুর্থ বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয় শুধু সংসদ সদস্যদের দ্বারা। এর বাইরে সংবিধানের আওতায় অন্য আইন দ্বারা নিরূপিত অন্যান্য দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাতে পারে। এর আওতায় আলাদা আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ওপর স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

ভিন্ন ভিন্ন আইনের মাধ্যমে সর্বস্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে অনুষ্ঠিত হলেও এসব নির্বাচন সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্বাচন। এসব নির্বাচন সরকার চাইলে আইনের পরিবর্তন সাপেক্ষে নিজেও করতে পারে। বিশ্বের বহু দেশে, এমনকি ভারতেও এ ধরনের নির্বাচন রাজ্য সরকারের বিষয়। ওই সব নির্বাচন রাজ্য সরকার চাইলে নির্বাচন কমিশন কারিগরি সহায়তা করে মাত্র। আমাদের দেশে নির্বাচন ছাড়া বাকি সবই সরকারের উল্লেখিত মন্ত্রণালয়ের। নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী কমিশন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ভোটের দিন ধার্য করে। ইতিপূর্বে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গত মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশনসংলগ্ন কয়েকটি ইউনিয়ন ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ করপোরেশনের সঙ্গে ১৮টি করে নতুন ওয়ার্ড মুক্ত করে। স্বভাবতই নির্বাচন কমিশন উত্তরের মেয়র নির্বাচনের সঙ্গে উত্তরের ১৮টি এবং দক্ষিণের ১৮টি ওয়ার্ডে নির্বাচন করার জন্য একই তফসিল ধার্য করে। এরপর বেশ কিছু আইনি অসংগতি দেখিয়ে রিট আবেদন হলে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়।

রিটকারীদের আবেদনে যেসব কারণ দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে দুটি কারণ ছাড়া বিদ্যমান আইনের আওতায় বাকি কারণগুলো ধোপে টেকে না। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী রিট আবেদনকারীরা যে কয়েকটি মূল কারণ দেখিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন, তার মধ্যে মূলগুলো হচ্ছে যেসব ইউনিয়ন ভেঙে ওয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে, সেখানকার নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদগুলো বাতিল করা হয়নি; যেহেতু দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন প্রায় দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাই নতুন ওয়ার্ডগুলোর নির্বাচিত কমিশনারদের মেয়াদের সময়সীমা কী হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য।

এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি বিষয়ে রিটকারীরা অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল ভোটার তালিকা সম্পন্ন না করা এবং নতুন ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করে ৩০ জানুয়ারি মূল তালিকায় যুক্ত করার কথা থাকলেও সেই তালিকার কারও প্রার্থী হওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া। কারণ, নির্বাচন কমিশন বলেছিল যে নতুন তালিকা থেকে কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না।

আইনের সব দিক বিবেচনা করেই এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের সচিবালয় থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে অনেক বিষয়েই অস্পষ্টতা ছিল। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার আগে সাধারণত এ ধরনের আইনি ফাঁকফোকর থাকলে সেগুলো সুরাহা করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন-উভয়েরই।

বর্তমান দুই সিটি করপোরেশনের মেয়াদ দুই বছরের বেশি সময় পার হওয়ার পর নতুন ৩৬টি ওয়ার্ড গঠন করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এটা আদৌ খুব জরুরি ছিল কি না? এসব ওয়ার্ড পরবর্তী নির্বাচনের আগেই যুক্ত করলে বর্তমানের এই আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হতো না। সিটি করপোরেশন ২০০৯-এর ধারা ৫-এর উপধারা (৩)-এ বলা আছে, পঁচাত্তর ভাগ কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে করপোরেশন গঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে নারী কাউন্সিলরসহ পঁচাত্তর ভাগ নির্বাচিত হয়েছে কি না-এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি জরুরি। এটা উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্যকারিতা ব্যাহত করবে কি না, সে বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। এরপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আইনের ধারা ৬-এর ব্যাখ্যা। এ ধারায় এ ধরনের নির্বাচনে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ কত সময়ের হবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসব জটিলতা দূর করতে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছিল কি না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিজেও উদ্যোগ নিতে পারত।

সবকিছু মিলিয়ে এটা পরিষ্কার হয় যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এবং নির্বাচন কমিশনের অসাবধানতাবশত অথবা তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের উদ্যোগের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ওয়ার্ডগুলো সংযুক্তির ফলে যে আইনি জটিলতার প্রেক্ষাপটে নির্বাচন স্থগিত হয়েছে, সেগুলো নিরসন করা খুব একটা জটিল কাজ বলে মনে হয় না। তা ছাড়া ওই ওয়ার্ডগুলোর সংযুক্তি বাতিল করে শুধু ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচনে আর কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে কি না, তা খতিয়ে দেখতেও অনেক সময় লাগার কথা নয়।

অন্যদিকে ভোটার তালিকা বা নতুন তালিকা থেকে কোনো ভোটার বয়সের দিক থেকে যোগ্য হলে প্রার্থী হতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। প্রথমত যাঁরা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁদের তালিকা চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হওয়ার তারিখ ছিল ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, অথচ ভোট গ্রহণের দিন ধার্য ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি, কাজেই নতুন ভোটাররা অবশ্যই চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেতেন এবং ভোট প্রদান করতে পারতেন। এমনকি ভোটার তালিকা আইন ২০০৯-এর ধারা ১৫ মোতাবেক নতুন তালিকা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা বা তৈরি করা না গেলেও পুরোনো ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। ওই একই ধারা মোতাবেক কোনো ভোটার এবং প্রার্থী হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনে আবেদন করলে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যেই ওই ব্যক্তিকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় বা যেত। কাজেই এ কথা সঠিক নয় যে নতুন ভোটার তালিকা কার্যকর না হলে একক যোগ্য ব্যক্তি প্রার্থী হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান সঠিক ছিল না।

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আদালত কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের রিটের মীমাংসা করতে গিয়ে অতীতে নির্বাচন কমিশনকে নানা ধরনের জটিলতায় পড়তে হয়েছিল। শুধু ২০০৮ সালের নির্বাচনের ১০ দিন আগে আদালতের একতরফা রায়ের কারণে প্রায় ২৪ লাখ ব্যালট পেপার বাতিল ও পুড়িয়ে নতুন ব্যালট পেপার ছাপাতে হয়েছিল। প্রায় ১৭টি আসনে ব্যাপক রদবদল করতে হয়েছিল। (লেখকের বই নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর, পৃ.৪৪৪-৪৪৬ দ্রষ্টব্য)।

২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এ ধরনের বহু অভিজ্ঞতার কারণে ওই সময়কার এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত রিট নিষ্পত্তি বা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ না দেওয়ার সুপারিশ করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করেছিল। ওই সময় এ বিষয়ে দেশের প্রখ্যাত আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে একটি আইনি ধারার খসড়া সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া হয়েছিল। কমিটি হুবহু ওই সুপারিশ অনুমোদন না করে এ ধরনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া ও শুনানি ছাড়া কোনো রায় বা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ না দেওয়ার সুপারিশ করে। বিধানটি সংবিধানের ১৫ তম পরিবর্তনের সময় ১২৫ (গ) ধারা হিসেবে সংযুক্ত করা হয়।

বর্তমান ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে নোটিশ ও পর্যাপ্ত সময় দেওয়া এবং সে অনুযায়ী শুনানি হয়েছে কি না, তা নির্বাচন কমিশনই ভালো বলতে পারবে। তেমনটা না হলে নির্বাচন কমিশন উচ্চতর আদালতে এ বিষয়ে আপিল করতে পারে। অবশ্য এটি সম্পূর্ণই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়।

তবে প্রথম আলোতে ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) মোখলেসুর রহমান এবং রিটকারীর আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকীর দুটি বক্তব্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ডিএজি বলেছেন, আদালত মৌখিকভাবে আইনজীবীকে ডেকে এনেছিলেন এবং রিটের দরখাস্তের কপি ইসিকে দেওয়ায় তিনি ‘আদালতের যুক্তিসংগত নোটিশ’ হিসেবে গণ্য করেছেন। আমি কমিশনার হিসেবে কাজ করার পাঁচ বছরে আদালতের নোটিশ কী, তা দেখেছি। তাই শুধু রিটের দরখাস্তের কপি বাদীপক্ষ দ্বারা ইসিকে সরবরাহ করা এবং ইসির ওকালতনামা ছাড়াই ‘হঠাৎ’ শুনানিতে গিয়ে পাঁচ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে ‘যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানি’ করার সাংবিধানিক শর্ত যথাযথভাবে পূরণ হয়েছে বলে মনে হয় না। আর কামরুল হক সিদ্দিকী একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী, তিনি কী করে ১২৫গ অনুচ্ছেদ শুধু সংসদের জন্য প্রযোজ্য বলতে পারেন, তা আমাকে অবাক করেছে। কারণ, সেখানে পরিষ্কারভাবে সব ধরনের নির্বাচনের বিষয়ে বলা হয়েছে।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।