ভাষা ভাত ভোট

ফেব্রুয়ারি এলে আমাদের ভাষার কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, প্রাণবান রেখেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিজয়ী করছে দুটি বিশেষ উপলক্ষ, দুটি সুবর্ণ সময়কাল-এক. একুশে ফেব্রুয়ারি, দুই. মুক্তিযুদ্ধ।

বাংলাদেশকে যদি তুলনা করি একটা রকেটের সঙ্গে, তাহলে ভাষা আন্দোলন এই রকেটটাকে উৎক্ষেপণ ক্ষেত্রে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে, আর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ওই রকেটটাকে গতি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে মহাকাশপানে। আমরা ছুটেই চলেছি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেল। আমরা হলাম পাকিস্তানি। পাকিস্তান হয়েছে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট। গ্রাম থেকে লোকে দল বেঁধে ঢাকা শহরে এসেছে আলোকসজ্জা দেখতে-লাটভবনে, সলিমুল্লাহ হলে আলো জ্বালানো হয়েছিল।

ওই জোশ কেটে যেতে মোটেও সময় লাগেনি, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে, ১৯৪৮ সালে খুব বড় ভাষা আন্দোলন হয়, হরতাল হয়, হরতালে পুলিশ আক্রমণ করে আর শেখ মুজিবুর রহমানসহ বহুজন গ্রেপ্তার বরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও সেই ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে।

তারপর এল অমর একুশে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রক্ত দিলেন বরকত, রফিক, জব্বার, শফি, সালাম। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিই হোক আর বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারই হোক, তা আদায়ের জন্য বাঙালিরা দুটি উপায় অবলম্বন করেছিল-এক. গণতান্ত্রিক আন্দোলন। দুই. নির্বাচন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা অর্জনের পথে বাঙালিকে নিয়ে গেলেনই এ দুটি উপায় অবলম্বন করে। তিনি রাজপথের আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন এবং বিশ্বাস করতেন সেই আন্দোলন হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা, মিছিল, সভা-সমাবেশ করা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা-এগুলো মৌলিক মানবাধিকার, এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায় না।

আর বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন ভোটে। তিনি বারবার করে বলতেন, ভোট দিন, দেখা যাবে, দেশের মানুষ কী চায়, কাকে চায়।

১৯৫২ সালে সারা পূর্ব বাংলা, যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জেগে উঠল, তার ফল ফলল ১৯৫৪-এর নির্বাচনে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো, বিজয়ী হলো যুক্তফ্রন্ট, যাদের ২১ দফার প্রধান দফা ছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, ভাষার প্রশ্নটির মীমাংসার জন্যও বাঙালিরা আন্দোলনের পাশাপাশি ভোটকেও উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ৩২ বছর বয়সী শেখ মুজিবুর রহমান চীনে গিয়েছিলেন পিকিং শান্তি সম্মেলনে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন: ‘আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য।...আমার বক্তৃতার পর মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে কেউ ভাগ করতে পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ, আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি। ” ’

মনোজ বসুও তাঁর চীন দেখে এলাম বইয়ে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন চমৎকারভাবে।

ভাষার অধিকারের লড়াইয়ের পাশাপাশি ছিল ভাতের অধিকারেরও লড়াই। ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলায় খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তখন প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন। মানুষ ভাতের দাবিতে মিছিল করছিল। ভুখা মানুষের খালি পা মিছিলে কেঁপে উঠেছিল ঢাকা। সেসব মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৬ সালের ২৮ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাক থেকে উদ্ধৃতি দিই।

আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টন ময়দানের জনসভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র কায়েম থাকিলে এই অবস্থার সৃষ্টি হইত না। তাই গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য সকলের নিকট এক মহান দায়িত্ব আসিয়া পড়িয়াছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশের এই সংকটজনক মুহূর্তে গণতন্ত্রকে কায়েম রাখার জন্য সকলের নিকট এক কাতারে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি বলেন, আমরা কন্ট্রোল ডেমোক্রেসি চাই না, পিওর ডেমোক্রেসি চাই।’

এটা মোটেও বিস্ময়কর কিছু নয় যে আমাদের পিতৃপুরুষেরা একদম সঠিক কথাটাই ভাবতেন, ঠিক কথাটাই বলতেন। যে কথা তাঁরা ১৯৫৬ সালে বলেছেন, গণতন্ত্র না থাকলেই কেবল দুর্ভিক্ষ হতে পারে, সে কথাই তো নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন এখন বারবার করে বলছেন, যে দেশে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে তাঁর লেখায় আর ভাষণে কতবার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেছেন! তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী কিংবা কারাগারের রোজনামচা বইয়ে বারবার করে আমরা এ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট মত জানতে পারি। তিনি জাতীয় পরিষদে কিংবা প্রাদেশিক পরিষদের ভাষণগুলোতেও গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের কথা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা, বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি কারাগারে আছেন, বাইরে হরতাল-আন্দোলন হচ্ছে, খবরের কাগজের ওপর সেন্সরশিপ, কারাগারের ভেতরে নানা গুজব শোনা যাচ্ছে, কেউ বলছে গুলিতে ২০০ জন মারা গেছে, কেউ বলছে হাজার। শেখ মুজিবের উপলব্ধি, সংবাদপত্রকে সত্য প্রকাশ করতে না দিলে তার ফল খারাপ হয়, গুজব ছড়ায়, গুজব আরও বিপজ্জনক।

এবং বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন ভোটে। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভোট হোক, তাহলেই তিনি প্রমাণ করতে পারবেন, বাংলার মানুষ কী চায়। আইয়ুব খানের পতনের পর যখন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নিলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে একটাই শর্ত দিলেন, ভোট দিতে হবে। কারণ তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাস করতেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে। আর তিনি জানতেন দেশের মানুষ কী চায়।

কথাটা দাঁড়াল, বাংলার মানুষ ভাষার মর্যাদা চায়, বাংলার মানুষ ভাতের অধিকার চায়, তা অর্জনের জন্য তারা ভোটের অধিকার চায় আর এই তিন চাওয়া মিলিত হয়ে পরিণত হলো বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে। হয়ে উঠল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। কিন্তু ভাষা, ভাত ও ভোটের জন্য আমাদের যে সংগ্রাম, তা তো এখনো শেষ হয়নি।

কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, এই সব বর্ণমালা দিতে হবে ভূমিহীনের ঘরে। আমাদের প্রতিটা মানুষকে সাক্ষর করে তুলতে হবে। সেই লড়াইয়েও আমরা অনেকটা দূরই এগিয়ে গেছি। আমাদের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। সেই হার হয়তো ৯৮ ভাগের বেশি, ৯৯ ভাগ। কিন্তু শতকরা ১ ভাগও অনেক। দুই নম্বর প্রশ্নটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে বটে, তারা শিখছে তো! শিখছেটা কী?

আমাদের শিক্ষার্থীদের সাক্ষর করতে হবে, সাক্ষর বলতে বাংলা তারা শিখবে, ইংরেজিও তারা শিখবে, গণিত তারা শিখবে এবং আজকের দিনে আরেকটা সাক্ষরতার দরকার হবে-কম্পিউটার-সাক্ষরতা। শিক্ষার মানের ধস আমাদের উদ্বিগ্ন করে।

কিন্তু এরপরও আমরা জানি, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর যুদ্ধজয়ী জাতি হারতে পারে না। সীমান্তবর্তী গ্রাম কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা মেয়েরা ফুটবল খেলে ভারত-সিঙ্গাপুরকে হারিয়ে দেয়। কক্সবাজার থেকে এসে মুমিনুল শত রান করেন। সারা বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী, যাদের প্রায় সবাই পড়ে বাংলা মাধ্যমে।

বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎও তো তাদেরই হাতে। এবার প্রথম আলোর দেওয়া জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার পেলেন যে দুজন, তাঁদের দুজনই নারী, আর দুজনই এসেছেন গ্রাম থেকে। কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার পেলেন ছয়জন, ছয়জনই উঠে এসেছেন ঢাকার বাইরে থেকে।

কাজেই আশায় আশায় বুক বাঁধি। শুধু আমাদের শিক্ষার মানটা যদি আমরা বাড়াতে পারতাম! আর গণতন্ত্রকে যদি ‘পিওর’ করে তুলতে পারতাম! ভাষা, ভাত আর ভোটের সংগ্রাম যে এ দেশের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে বাঁধা!

আনিসুল হক সাহিত্যিক ও সাংবাদিক