বিবাহে মহর, যৌতুক ও উপহার

বিবাহ একটি ইবাদত। ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজীবনের যাবতীয় কর্মকালই ইবাদত। দাম্পত্য জীবন মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সুতরাং, দাম্পত্য জীবনের সূচনাপর্ব শুভবিবাহ সুন্নত অনুযায়ী ও শরিয়াহসম্মতভাবে সম্পাদন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দাম্পত্য যুগলবন্দী হওয়ার পদ্ধতিকে বাংলা পরিভাষায় ‘বিবাহ’ বা ‘বিয়ে’ বলা হয়। উর্দু ও ফারসি ভাষায় একে বলা হয় ‘শাদি’, আরবিতে বলা হয় ‘নিকাহ’।

মহর
মহর শব্দটি আরবি, এর বাংলা উচ্চারণ মাহর, মুহর, মোহর। মহর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দান-অনুদান। সোনার তৈরি মুদ্রাবিশেষ বা স্বর্ণমুদ্রাকেও মহর বলা হয়। নামের সিল বা ছাপও মহর নামে পরিচিত। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় বিয়ের সময় বরের পক্ষ থেকে কনেকে যে অর্থ বা সম্পদ দেওয়া হয়, তাকে মহর বলে। বিবাহ সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আকদ’। প্রস্তাব, গ্রহণ, সাক্ষী ও মহর হলো ‘আক্দ’ সম্পন্ন হওয়ার মৌল তিন উপকরণ। এর লিখিত রূপ হলো ‘কাবিন’।

অনেক সময় কাবিনে উল্লিখিত বা নির্ধারিত মহরকেও ‘কাবিন’ বলা হয়ে থাকে। কখনো মহর অনির্ধারিত বা ঊহ্য থাকলে ‘মহরে মিছল’ বা ‘সমমান মহর’ বর্তাবে। ‘মহরে মিছল’ বা ‘সমমান মহর’ হলো সমপর্যায়ের, সমবয়সের, সমমর্যাদাপূর্ণ, সমমান, সমরূপ ও সমগুণসম্পন্ন অন্য কোনো মেয়ের প্রচলিত সাধারণ মহরের সমান।

‘মহর’ হলো বিয়ের সময় বর কর্তৃক কনেকে প্রদত্ত সম্মানী; যার মাধ্যমে সে স্বামীর অধিকার লাভ করে। মহর নগদে প্রদান করা উচিত। উভয় পক্ষের সম্মতিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ বাকিও থাকতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিশোধযোগ্য।

মহর বিয়ের অন্যতম ফরজ। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন: ‘আর তোমরা নারীদিগকে তাদের মহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে; সন্তুষ্ট চিত্তে তারা মহরের কিয়দংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বচ্ছন্দে উপভোগ করবে।’ (সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ৪)। মহরের পরিমাণ উভয় পক্ষের সম্মতিতে বরের সামর্থ্য ও কনের যোগ্যতা বিবেচনায় নির্ধারিত হবে। এর সর্বনিম্ন কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই। কোরআন করিমে বলা হয়েছে: ‘আর যদি তোমরা তাদের কোনো একজনকে অগাধ সম্পদ বা অঢেল অর্থও দিয়ে থাকো, তবু তা হতে কিছুই প্রতিগ্রহণ কোরো না।’ (সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ২০)। তবে মহরের পরিমাণ এত কম হওয়া উচিত নয়, যাতে মেয়ের সম্মান ও অধিকার ক্ষুণ্ন হয় এবং এত বেশি হওয়াও বাঞ্ছিত নয়, যা ছেলের ওপর জুলুম হয়। মহর পরিশোধের উদ্দেশ্যেই নির্ধারণ করতে হবে, শুধু নামের জন্য নয়।

মহরের অর্থ একান্তই স্ত্রীর। এই অর্থ তিনি যেভাবে খুশি ব্যয় করতে বা সঞ্চয় রাখতে পারবেন অথবা বিনিয়োগ করবেন। তিনি যাকে ইচ্ছা দান-অনুদান বা উপহার ও হাদিয়া হিসেবে দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা অন্য কারও কিছু বলার থাকবে না।

যৌতুক
ইসলামি বিধানমতে কনের পক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে-পরে শর্ত করে বা দাবি করে অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থ-সম্পদ ও টাকাপয়সা নেওয়া বা দেওয়াকে যৌতুক বলে। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। বাংলা অভিধানমতে, যৌতুক হলো ‘বিবাহের পর বর বা কনেকে যে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত উপহার।’ (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান)। এই অর্থে যৌতুক ও মহরের মধ্যে বিভ্রাট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ইসলামে মহর হলো ফরজ ইবাদাত আর যৌতুক হলো বিলকুল হারাম ও সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তাই যৌতুক ও মহর এই উভয়ের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা জরুরি।

‘ছেলেপক্ষ যে অর্থ দেয় তা হলো মহর, মেয়েপক্ষ যা দেয় তা হলো যৌতুক।’ মেয়ের বাড়িতে শর্ত করে আপ্যায়ন গ্রহণ করাও হারাম যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুক চাওয়া ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা নিন্দনীয় ও জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধ। আমাদের দেশের আইনেও যৌতুক শাস্তিযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যৌতুকের শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হলে, বিয়ে কার্যকর হয়ে যাবে; কিন্তু যৌতুকের শর্ত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে অবৈধ শর্ত পালনীয় নয়, বরং বাধ্যতামূলকভাবেই তা বর্জনীয়।

উপহার
নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ দানকে উপহার বলা হয়। এই উপহার যে কেউ যে কাউকে যেকোনো সময়ে যেকোনো অবস্থায় যেকোনো অবস্থানে যেকোনো অবস্থান থেকে দিতে পারেন। সুতরাং, বিয়ের সময় বা তার পরে স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে যেকোনো কিছু উপহার দিতে পারেন।

স্বামীর দেওয়া উপহার সাধারণত মহরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। কখনো যদি মূল্যবান গয়না ও অলংকার মহরের মধ্যে শামিল করা হয়, তখন বলা হয়ে থাকে ‘জেওর ও মহর’ এত টাকা এবং জেওর বা অলংকার বাবদ ওয়াসিল বা পরিশোধ এত টাকা। কনের পরিবারের পক্ষ থেকে শর্ত ও দাবি ছাড়া বরকে কোনো উপহার দিতে বাধা নেই। তবে প্রথা বা অঘোষিত শর্তরূপে দিতে বাধ্য হলে তা পরিহারযোগ্য। বিবাহ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বর ও কনেকে উপহার দিতে পারেন। তবে এটি যেন প্রথারূপে না হয়। উল্লেখ্য যে মহর প্রদেয়, উপহার অফেরতযোগ্য।

বিয়ের সময় প্রদত্ত উপহারসামগ্রী বা অর্থের মালিক বর বা কনে। যে উপহার যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনিই সেই উপহারের মালিক। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য কেউ মালিকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এসব উপহার কাউকে দিতে পারবেন না এবং যথেচ্ছ ব্যবহারও করতে পারবেন না। স্ত্রী বা কনে প্রাপ্ত উপহার নিজে ব্যবহার করা ছাড়াও যাকে খুশি কারও অনুমতি ছাড়া দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা বরপক্ষের কারও কোনো এখতিয়ার থাকবে না; যদিও সেই উপহারসামগ্রী স্বয়ং স্বামী বা বরপক্ষই দিয়ে থাকে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম-এর সহকারী অধ্যাপক
[email protected]