তিনি জানতেন, সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুত্বপূর্ণ

এম এ ওয়াহ্হাব মিঞা
এম এ ওয়াহ্হাব মিঞা
>
  • জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে ২২তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলো
  • আওয়ামী লীগের গত সাত বছরে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি পদত্যাগ করলেন

বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগে কোনো বিস্ময় নেই, এটা আকস্মিক নয়। সরকার ও আদালতের সংশ্লিষ্ট মহলের এটা প্রায় সবারই জানা ছিল, তাঁকে ডিঙানো হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। কারণ, অনেক আগে থেকে তিনি প্রায়ই এটা প্রকাশ্যে বলতেন। 

এমনকি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছেও বারবার বলেছেন, জ্যেষ্ঠতার নীতি মানা না হলে তিনি থাকবেন না। তাই মনে হয় সরকার ভেবেচিন্তেই তাঁর পদত্যাগ এবং বিব্রত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে। তবে সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ এটা এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিঞা কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলে আওয়ামী লীগের যুক্তি ও ব্যাখ্যা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি ওই রায়ে আরও বলেছিলেন, ‘প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গি (পারসেপশন) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (ভাইটাল) ভূমিকা রাখে।’ এ ছাড়া ২৮ বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নেতা হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে যে প্রস্তাব পাস করিয়েছিলেন, গতকাল তার আরেকটি লঙ্ঘন তিনি তাঁর নিজের জীবনেই প্রত্যক্ষ করলেন। এরশাদের সামরিক শাসনে তিনি জেলও খেটেছিলেন।
গত ৯ বছরে তৃতীয়বারের মতো জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে বাংলাদেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলো। আওয়ামী লীগের গত সাত বছরে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি পদত্যাগ করলেন। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার প্রস্থানপর্বে ওয়াহ্হাব মিঞার ভূমিকা সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। অনেকে এটা তাঁর আপসকামিতা হিসেবে দেখেন। তাই কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছিলেন যে তিনি হয়তো প্রধান বিচারপতি হতে পারেন। প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে আনা সরকারের দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া লিখিত বিবৃতির বিচারিক যথার্থতা নিয়ে অনেকেই গুরুতর প্রশ্ন তুলেছিলেন।
১৯৮৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী অবসরে গেলে জেনারেল এরশাদ কর্মে প্রবীণতম বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে চাননি। তখন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হিসেবে তাঁর আনা প্রস্তাব পাস হয়েছিল: আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা ‘সাংবিধানিক রেওয়াজ ও ঐতিহ্য’।
বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত ১০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। বিচারপতি সিনহা তাঁর পদত্যাগপত্রে ‘কারণ’ ব্যাখ্যা করেছেন। মনে হয়, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সিনহার স্বাভাবিক অবসরের তারিখটি পেরোনোর অপেক্ষায় ছিলেন রাষ্ট্রপতি। ৩১ জানুয়ারি সিনহার অবসরে যাওয়ার তারিখের পরেই নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে গত ৯ বছরে অনেক পর্যবেক্ষকের মতে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ তৃতীয়বারের মতো আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারককে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। এর আগে একজন বিচারককে একাধিকবার ডিঙানোর পরেও তাঁর প্রধান বিচারপতি হওয়ার নজির ছিল। কিন্তু বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার অবসরে যাওয়ার তারিখ ছিল আগামী ১০ নভেম্বর। আর নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির অবসরের তারিখ ২০২১ সালে। তাই বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিঞার পক্ষে প্রধান বিচারপতি হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই।

দুবার ডিঙানো
এর আগে ২০১০ সালে বিচারপতি এম এ মতিনকে ডিঙিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি করা হয়। এর প্রতিবাদে বিচারপতি এম এ মতিন আর আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এজলাসে বসেননি। অপর বিচারপতি শাহ আবু নইম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে ২০১১ সালে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি করার পরদিন তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। একটি মাত্র বাক্যে তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র লিখেছিলেন। তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে কোনো কারণ ব্যাখ্যা করেননি বলে জানা গেছে।
বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির চেয়ে দেড় বছর আগে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পদত্যাগী বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিঞা ও নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি যথাক্রমে ১৯৯৯ সালে এবং ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম হাইকোর্টের বিচারক হন। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ উভয়ে একই দিনে আপিল বিভাগের বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন।

বিলম্বের নেপথ্যে
আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক এর আগে প্রথম আলোকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অবসরের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের যোগসূত্র নাকচ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটল। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর পদত্যাগপত্রে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। এ কারণে তাঁর পদত্যাগপত্র ‘গ্রহণ’ করলেও প্রধান বিচারপতি পদ শূন্য বা সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদের আওতায় অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।
জানতে চাওয়া হলে আইনমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হলে কখনো কি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে?’ তিনি কি এক বাক্যের একটি নিরীহ পদত্যাগপত্র দিয়েছেন? এর উত্তরে আইনমন্ত্রী অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি এক বাক্যের পদত্যাগপত্র দেননি। আইনমন্ত্রী নিশ্চিত করেছিলেন যে ষোড়শ সংশোধনীর রায় প্রসঙ্গে তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে মন্তব্য করেছিলেন।
এ ছাড়া মনে হয়, সরকার সিনহার পদত্যাগের ঝড়ের পরে আপিল বিভাগে আরেকটি সম্ভাব্য পদত্যাগের চাপ কমাতেও সময় নিয়েছিল।

দুধভাত
ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে পদত্যাগী বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে গত বুধবার নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে যেসব যুক্তি দেন, তা নাকচ হয়ে যায়।
ওই রায়ে বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিঞা বলেছিলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রবর্তন করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরি সংবিধানসম্মত এবং বাংলাদেশের বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর অধীনে নির্বাচন করার কোনো বিকল্প নেই। কোনোভাবেই এটা গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ক্ষমতার পৃথক্করণ, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।’ ২০০৬-০৮ সালে সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থার অপব্যবহারের জন্য তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, ব্যর্থতা ব্যক্তির, ব্যবস্থার নয়।
বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের দ্বারা নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর আসীন থাকার ধারণা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নির্বাচিত ও অনির্বাচিতদের যুক্তি খণ্ডন করে তিনি লিখেছিলেন, ‘সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরে প্রধান উপদেষ্টা ও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা সমান্তরাল হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল যদি সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করে কারচুপি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের নির্বাচিত ঘোষণা করে, তাহলেও তাদের সংবিধানের ৬৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচিত বোঝাবে না। তেমন সংসদকে সত্যিকার অর্থে বৈধ বা সার্বভৌম বলা যাবে না। সেই সংসদের জনপ্রতিনিধিত্ব চরিত্র থাকবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে না।’
ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে ২০১২ সালে প্রকাশিত ওই পর্যবেক্ষণের পাঁচ বছর পরে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আলোচিত ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়েও পুনরায় লিখেছিলেন, ‘ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, একটি “পোশাকি গণতন্ত্র” “প্রকৃত গণতন্ত্রকে” ধ্বংস করে দিয়েছিল।’
নির্বাচনকালীন সরকারের যে ধারণা সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার দিয়েছেন, তার বিপরীতে একটা জোরালো ব্যাখ্যা তাঁর রায়ে উল্লিখিত আছে বলে মনে হয়। শেখ হাসিনা সংসদে পুনরায় বিএনপির ‘সহায়ক সরকারকে’ সংবিধান পরিপন্থী বলেছেন। আর বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা বিলুপ্ত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই বাংলাদেশের জন্য একান্ত দরকারি মনে করেছিলেন।
ক্ষমতাসীন দল থেকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন হওয়ার বহুল ব্যবহৃত উদাহরণের বিরুদ্ধে তাঁর উত্তর, ‘অন্তর্বর্তীকালীন বা নিয়মিত সরকারের ধরন কী হবে তা প্রতিটি জাতি তার প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট করে এবং তা নিয়ে তাদের গর্বিত হওয়ারও সুযোগ থাকে। নির্বাচনকালে মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় থাকলে দলের সঙ্গে তাদের শক্তিশালী সংশ্লিষ্টতা থাকে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা তাঁদের সব ধরনের সরকারি সুবিধাসহ নির্বাচনী ইশতেহার ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এ কারণে জনপ্রশাসন তাঁদের প্রভাবে নাজুক থাকে এবং এ কারণে তাঁরা নির্বাচনে কারচুপি করতে সক্ষম হন। অথচ অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার সেভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারণ থাকে না।’
ত্রয়োদশ সংশোধনী একটি সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা তাঁর রায়ের উপসংহারে মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে একবাক্যে সহমত পোষণ করেছিলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। মামলার রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দ্বারা রায় পরিবর্তনের বিষয়েও তিনি ভিন্নমত দিয়েছিলেন।
লক্ষণীয় যে ষোড়শ সংশোধনীর সর্বসম্মত রায়ে তিনি আরও লিখেছিলেন, সংসদের পাস করা আইন বাতিলে আদালতের এখতিয়ারের বিধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই করে গেছেন, যা পরে কখনো খর্ব করা হয়নি। ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ১৬ তম সংশোধনী না থাকার যুক্তিও তিনি তাঁর রায়ে দিয়েছিলেন।
পদত্যাগী বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিঞা সংসদের উদ্দেশে নির্দিষ্টভাবে এই মন্তব্যও করেছিলেন যে, ‘সংবিধানের সংশোধনী দুধভাতের মতো হওয়া উচিত নয়। আমি এটা বলছি কারণ ৩০ জুন ২০১১ সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পাস করানো হয়েছিল, সেটা মাত্র ৩ বছর ২ মাস ১০ দিন যেতেই ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করা হলো।’
জামালপুরের মাদারগঞ্জ থেকে তিনি ময়মনসিংহ বারে ১৯৭৪ সালে একজন সাধারণ আইনজীবী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ঢাকায় তাঁর দীর্ঘকালীন সিনিয়র ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি এইচ খান। ছাত্রজীবনে কোনো সংগঠন করেননি। দুই ছেলে (প্রকৌশলী ও আইনজীবী), এক মেয়ে (ব্যাংকার)। স্ত্রী গৃহবধূ। উত্তরায় প্লট পেয়েছিলেন, এখনো খালি পড়ে আছে। ঢাকায় বাড়ি নেই।