ছাত্ররাজনীতিতে সরকারি রাহু

শিক্ষা খাত যে কীভাবে শাসকনীতি ও নৈরাজ্যের শিকার, তার বহু প্রকাশ দেখছি আমরা। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকেরা একের পর এক ঢাকার রাস্তায় অবস্থান-অনশনে দিন-সপ্তাহ-মাস পার করেছেন গত কিছুদিনে। তাঁদের দাবি প্রধানত নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হলেও তা শিক্ষা খাতকে নৈরাজ্য থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যকেই হাজির করে। সব নাগরিকের শিক্ষা যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ নয়, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশই যে একমাত্র করণীয়, সেই তাগিদই উপস্থিত হচ্ছে বারবার।

রাজপথে যখন শিক্ষকেরা অনশনে, তখন শিক্ষার নৈরাজ্যের আরেকটি চিত্র প্রকাশিত হয়েছে সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানের সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের তাণ্ডব এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সন্ত্রাস তারই আরেকটি নমুনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদী সমাবেশ-মিছিলের ওপর তাদের আক্রমণ চলছে।

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব উপাচার্য ও প্রক্টরই শিক্ষক। কিন্তু তাঁদের অনেকের মধ্যেই শিক্ষকের চাইতে পুলিশ বা আমলা বা সরকারদলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করার প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে বেশি। সন্ত্রাস দমনে তাঁদের আগ্রহ নেই, কেননা সন্ত্রাসীদের তাঁরা নিজেদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে চান। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো সরকারি দলের কমিটিতেই আছেন।

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান ও গভর্নর মোনায়েম খান সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ) তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনের সহযোগী হিসেবে ক্রমবর্ধমান গণপ্রতিরোধকে বাধা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল। তারা প্রতিবাদের সব তৎপরতা নিশ্চিহ্ন করার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ত্রাস ছড়াত, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করত, এমনকি শিক্ষকদেরও রেহাই দিত না। ইতিহাস পর্যালোচনায় পরিষ্কার দেখা যায় যে ছাত্রসংগঠনের সহিংস আচরণ বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর রাষ্ট্র-সমর্থিত সহিংসতা পাকিস্তানের এই সামরিক শাসনের সময় থেকেই শুরু হয়েছে। দুঃখজনকভাবে এই প্রবণতা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও থেমে যায়নি, বরং প্রতিটি সরকারের আমলে আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। কাজেই শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির সন্ত্রাস প্রকৃতপক্ষে সব ছাত্রসংগঠনের বৈশিষ্ট্য নয়, তা প্রধানত ‘শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের’ প্রবণতা। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ছাত্ররাজনীতির সমস্যা নয়, এটি সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের রোগ ও ভোগের প্রকাশ। ঘটনাক্রম দেখলে এটি স্পষ্ট হয় যে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পেশিশক্তি হিসেবেই কাজ করে। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি ২০১৮)

১৯৮০–এর দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে তারা ১০ দফা দাবি প্রণয়ন করে। এর প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করার পর এর বিপরীত যাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছে ৯০-পরবর্তী সরকারগুলো। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ভয়ংকর আকার নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কৌশলপত্র, এডিবির উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পসহ নানা ঋণনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়ন শিক্ষাবণিকদের জন্য শিক্ষা খাত উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকেন্ড, ইভনিং নামে বাণিজ্যিক তৎপরতা দিনে দিনে বাড়ছে। স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রেও বাণিজ্য ও শিক্ষার ধসও বাড়ছে।

অন্যদিকে একই সময়কালে শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ আরও সংকুচিত হয়েছে। ১৯৯১ থেকে কোথাও আর কোনো ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সরকারি দলের একাধিপত্য হলে হলে শিক্ষার্থীদের জীবনকে বিভীষিকাময় করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারি দল ও সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে ভিন্নমত প্রকাশের পথে বিঘ্নœ সৃষ্টির নানা পথ নিয়েছে, নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খবরের কাগজের অসংখ্য প্রতিবেদন দেখিয়েছে, কীভাবে ভূমি ও দোকান দখল, দরপত্র ছিনতাই আর বিরোধিতাকারীদের দমন করতে ভাড়াটে মাস্তান হিসেবে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা কাজ করছেন। কীভাবে এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বেতন বাড়ানো বা শিক্ষাবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য এই সংগঠনকে ব্যবহার করছে। এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দমন করতে মিথ্যা মামলা দিয়েছে প্রশাসন, ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়েছে আন্দোলনকারীদের ওপর—এ রকম উদাহরণ অনেক। এসবের বিনিময়ে সরকারপন্থী সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা যা চান তা-ই করার বিশেষ অধিকার অর্জন করেন। এসবের মধ্যে ছিনতাই, যৌন হয়রানির পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পরিবহন ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায় সবই অন্তর্ভুক্ত।

১ বৈশাখ নববর্ষের উৎসবে যৌন হয়রানির সিসিটিভি ছবি থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা ধামাচাপা দেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে এতে তাদের ক্ষমতাপুষ্ট লোকজনই জড়িত ছিল। খুন, চাপাতিসহ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, ত্রাস সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকা বহুবার খবর হলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বজিৎ হত্যার ভিডিও থাকায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব সরকার অস্বীকার করতে পারেনি, প্রবল জনমতের কারণে বিচারও হয়েছে। কিন্তু প্রধান আসামিরা সফলভাবে পলাতক থেকেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের হত্যার ক্ষেত্রেও ঘটনা একই। অর্থ-সম্পদের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে নিজ সংগঠনেই বহু খুনাখুনিতে ছাত্রলীগের কর্মীরাও অনেকে হতাহত হয়েছেন, এসব নিয়েও অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে।

‘ছাত্ররাজনীতি’র তাই দুটি প্রধান ধারা: একটি ধারা ক্ষমতাসীন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর রাজনীতি এবং সামাজিক সম্পর্কের কাছাকাছি থাকে; অন্যটি তাদের বদলানোর জন্য লড়াই করে। প্রথম ধারাটি সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে প্রকটভাবে প্রকাশিত, যা ক্ষমতাসীন দলকে প্রতিনিধিত্ব করে আর দখলকারী, লুটেরা, দুর্নীতিবাজসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের ভাড়াটে সৈনিকের মতো ভূমিকা পালন করে। এই ধারা তরুণদের শক্তি অবক্ষয়ের দিক নির্দেশ করে। দ্বিতীয় ধারাটি দৃঢ়ভাবে সংগঠিত নয়, পৃষ্ঠপোষণ পায় না, রাষ্ট্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে, সে কারণে পুলিশসহ ক্ষমতার নানা খুঁটির বৈরী আচরণ পায়। কিন্তু এই দ্বিতীয় ধারাটিই সমাজে নতুন জন্মের শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চা থেকে এখন অনেক দূরে। শাসক দলের ছাত্রসংগঠন যার প্রতিনিধিত্ব করে, তা আসলে একধরনের জমিদারি ব্যবস্থা, যা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা আইনি প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করে। এসব প্রতিষ্ঠানে তাই ছাত্ররাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুস্থ বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি এখনো একটি স্বপ্ন আর অব্যাহত লড়াইয়ের বিষয়। তারপরও অনেক প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও প্রতিটি সরকারের সময় সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাস আর রাষ্ট্রের বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঠিকই সরব হয়েছে শিক্ষার্থীরা। ‘সাধারণ ছাত্র ঐক্য’, ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা’, ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’, ‘নিপীড়ন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ’, ‘বেতন-ফি বৃদ্ধিবিরোধী ছাত্র ঐক্য’, ‘ভ্যাট নাই’ ‘ধর্ষণ প্রতিরোধ মঞ্চ’, ‘সুন্দরবনের জন্য আমরা’, ‘জাতীয় সম্পদ রক্ষা তরুণ সমাজ’, ‘ছাত্রসংসদের দাবিতে ছাত্রসমাজ’, ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী’ ইত্যাদি ব্যানারের অধীনে নতুন নতুন মঞ্চ দেখা গেছে গত কয়েক বছরে। যদিও এসব নতুন মঞ্চের কোনো স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো নেই, তবু শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশকে তাদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা প্রমাণিত। এর সঙ্গে বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও বাম সংগঠনগুলোর চেষ্টা অব্যাহত আছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের আহ্বানে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তার মুখ্য স্লোগান ছিল বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ক্রোধ, হুমকি এবং তাদের উচ্ছেদ করার ঘোষণা। অন্যায় নিপীড়ন বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেকোনো প্রতিবাদী ধারাই ক্ষমতাবানদের কাছে বাম হিসেবে নিন্দিত, তা কেউ কোনো সংগঠনে থাকুক বা না থাকুক। বামদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের এই ক্রোধ কেন? কারণ এরাই ছাত্ররাজনীতিকে সরকারি রাহু থেকে মুক্ত করতে চায়; বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, নিয়োগে অনিয়ম, বেতন-ফির অযৌক্তিক বৃদ্ধি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধিতা করে, নির্বাচিত ছাত্রসংসদের কথা বলে, সন্ত্রাস ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়; এরাই দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো চুক্তি বা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়; এরাই সীমান্ত হত্যা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এরাই সুন্দরবন রক্ষার পক্ষে লড়াই করে; ফিলিস্তিনসহ দেশে দেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

সুতরাং, এটা খুবই বোধগম্য যে বিভিন্ন সরকারের সময়ে ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য থেকে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, দেশ-বিদেশের মানুষ ও প্রকৃতিবিনাশী তৎপরতায় লিপ্ত নানা গোষ্ঠী এই সক্রিয় তরুণদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত থাকে। আর এ কারণেই প্রতিবাদের এই ধারাই নানা হতাশা আর নৈরাজ্যের মধ্যে বাংলাদেশ সমাজের জন্য আশার শক্তি তৈরি করে। 

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়