তৃণমূলে একটি নীরব নির্বাচন

নির্বাচন এ দেশে কখনো কোনো নীরব বা নিভৃতের ঘটনা নয়। সেই নির্বাচন পাড়ার ক্লাব-সমিতি, মসজিদ, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, হাটবাজার কমিটি, শহরের মহল্লা, সেক্টর, ব্লক যা-ই হোক। আর তা যদি আবার স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদ কিংবা পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ইত্যাদি হয়, তাহলে তো বিষয়টি একেবারে মহা তোলপাড় সৃষ্টিকারী ঘটনা। আমরা বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্রতিদিন ভোট ও জাতীয় নির্বাচনের কথা একাধিকবার স্মরণ করি। না চাইলেও তা শুনতে হয়, আমাদের রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা ও গণমাধ্যম আমাদের শুনতে বাধ্য করে।

এ রকম ‘নির্বাচনপাগল’ একটি জাতি জানুয়ারি ২৯,২০১৮-এ অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচন সম্পর্কে ছিল পুরোপুরি গাফেল ও বিস্মৃত। ওই দিন ছিল নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী দেশব্যাপী চতুর্থ উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের (৫৫টি জেলায়) নির্বাচন। সারা দেশে ছিল না কোনো পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার; গণমাধ্যমে ছিল না কোনো সংবাদ, প্রতিবেদন, টক শো; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার কোথাও কোনো আলোচনা ছিল না। অথচ দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে দেশি-বিদেশি অনুদানে কাজ করছে কত শত নারী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও এনজিও। তৃণমূল পর্যায়ের নারী নেতৃত্বের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসর উপজেলা পরিষদে জাতীয়ভিত্তিক একটি নির্বাচন, এই নির্বাচন নিয়ে কারও কোনো আগ্রহই দেখা গেল না। নীরবে-নিভৃতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে এই নির্বাচন একধরনের ‘ফলবিহীন’ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল।

বেখবর ও গাফেল থাকল দেশের মহান নারী নেতৃত্ব এবং সব রাজনীতিসচেতন অতিজন (elite) শ্রেণি। দেশে ১১টি সিটি করপোরেশন, ৩২৭টি পৌরসভা ছাড়াও ৬১টি জেলা পরিষদ, ৩৯১টি উপজেলা পরিষদ ও ৪ হাজার ৫২৯টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এই সব কটি পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে, যেখানে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে নারী প্রতিনিধিরা পরিষদসমূহে পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। উপজেলা পরিষদ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মধ্যম স্তরের স্থানীয় সরকার পরিষদ। এই পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত নারী প্রতিনিধির আসনসমূহ পূরণের ক্ষেত্রে সর্বত্রই একটি অবজ্ঞা, অবহেলা কিংবা অব্যবস্থাপনার চিত্র এই নির্বাচনের মাধ্যমে নতুনভাবে প্রকাশ পেল।

২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ওই পরিষদে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের জুন মাসে। ২০১৬ সালের মার্চ-জুন সময়ের মধ্যে যেহেতু পুনরায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাই এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই নবনির্বাচিত উপজেলা পরিষদের নারী সদস্যদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে চতুর্থ উপজেলা পরিষদের কার্যকাল শেষ হবে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে। সে হিসাবে নারী সদস্যদের প্রতিনিধিত্ববিহীনভাবে এই পরিষদের প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। তৃতীয় ও চতুর্থ উপজেলা পরিষদে এভাবে নারী প্রতিনিধিরা তাঁদের সুযোগ হারালেন। তাতে উপজেলা পরিষদ আইন ও সংবিধান লঙ্ঘিত হলো এবং নারীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হলো।

গত ২৯ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তা আরেকটি ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল। মোট ১ হাজার ৪৯৬টি শূন্যপদের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১ হাজার ৫টি আসনে (৬৭ শতাংশ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। অন্যদিকে ২৩২টি (১৫ শতাংশ) আসনে কোনো মনোনয়নপত্রই জমা পড়েনি। ভোট গ্রহণ স্থগিত থাকে ৫৯টি আসনে। বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বুকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন এবং মনোনয়নপত্রবিহীন নির্বাচনের আরও একটি নতুন নজির স্থাপিত হলো ২৯ জানুয়ারি। প্রশ্ন, এটি কেন হলো এবং কীভাবে এই অবস্থা থেকে আমরা বের হয়ে আসব?

প্রথমত, অংশগ্রহণবিহীন এই নির্বাচনের প্রধান কারণ কোনো রকম প্রচার ও প্রচারণা না থাকা। বর্তমানে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদগুলোর বেশির ভাগই সরকারি দলের করায়ত্তে। তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায়নি। দ্বিতীয়ত, এই পদে নির্বাচিত হওয়ার পর উপজেলা পরিষদে দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের কোনোরূপ আর্থিক সহায়তা করা হয় না। তৃতীয়ত, তাঁদের মেয়াদকালের অর্ধেকের বেশি ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তাতে নির্বাচন করার আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই কম হওয়ার কথা। চতুর্থত, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, ইউএনওসহ সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনৈতিক দলসমূহ বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভেবে প্রচার-প্রচারণা করেনি। পঞ্চমত, শহরকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজের সংগঠন, নারী সংগঠন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ও স্থানীয় সরকারের নানা প্রকল্পের বোধ হয় এ বিষয়ে কারও দান-অনুদান ছিল না। তাই তারাও কোনো প্রকার প্রচারণার বা আদৌ এ রকম একটি নির্বাচন পেন্ডিং ছিল বা এখন হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর রাখেনি।

ভবিষ্যতে কী করা দরকার, সে সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে বলতে হয় আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচনব্যবস্থার একীভূত বা সমন্বিত কোনো রূপ নেই, নেই কোনো একটি সুনির্দিষ্ট সময়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সময় আলাদা, আলাদা তাদের সাংগঠনিক কাঠামো। ইউনিয়ন নির্বাচনের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের কোনো মিল নেই। আবার জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। আমাদের স্থানীয় সরকারের আইন ও সাংগঠনিক কাঠামোর ব্যাপক সংস্কার দীর্ঘদিনের ফেলে রাখা বিষয়। এই সংস্কারের মধ্যে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ সব প্রতিষ্ঠানকে একই ধরনের কাঠামোয় প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব এবং একই তফসিলে একই দিনে অত্যন্ত সাশ্রয়ীভাবে সব নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। এ বিষয়ে আমরা কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করেছি এবং রিফর্ম অ্যাজেন্ডা ফর লোকাল গভর্ন্যান্স শিরোনামে প্রথমা প্রকাশন তা ২০১৬ সালে প্রকাশ করেছে।

বড় সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান আইনের অধীনেও সুষ্ঠুভাবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ভবিষ্যতে অনুরোধ করব। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনের তফসিলের সঙ্গে একই তফসিলে উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হতে পারে। মূল নির্বাচনের প্রার্থীদের শপথ গ্রহণের পরপরই এই নির্বাচনের তফসিল কার্যকর হলে তাঁরা পূর্ণাঙ্গ একটি মেয়াদে উপজেলায় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

তোফায়েল আহমেদ রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক এবং স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ
[email protected]