ঢাকা এক অভিভাবক পাবে কবে?

ভিআইপিরা উল্টো পথে চলেন পুলিশ প্রহরায়
ভিআইপিরা উল্টো পথে চলেন পুলিশ প্রহরায়

রাস্তায় ও যানজটে বসেই এখন ঢাকাবাসীর বেশি সময় কাটে। মোবাইল ফোন ও ফেসবুকই তখন আমাদের সঙ্গ দেয়। কিন্তু অপেক্ষার বিরক্তি কি আর এতে কাটে! জ্যামে বসে থাকার অসহ্য বিরক্তি আর এই ক্ষোভ জানানোর একটি জায়গাও তাই হয়ে উঠেছে ফেসবুক। কে কোন রাস্তায় কত সময় ধরে আটক আছে, কতক্ষণ গাড়ি এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বা গন্তব্যে পৌঁছাল কত ঘণ্টায়-এসব নিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বন্ধুর স্ট্যাটাস পাই।

যানজটে সবাই অস্থির। একমাত্র দেশি-বিদেশি ভিভিআইপিরা এ থেকে ছাড় পান। কারণ, তাঁদের নিরাপত্তার ইস্যু রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের ‘ভিআইপি’ যাঁরা, তাঁদের এ থেকে মুক্তি নেই। তাঁদের অনেকেই অবশ্য আইনকানুন মানা বাদ দিয়েছেন। সবাই যখন যানজটে আটকে আছে, তখন বড় বড় গাড়ি নিয়ে উল্টো পথে তাঁরা রওনা দেন। পুলিশের গাড়িও তাঁদের পাহারা দেয়। তাঁদের ক্ষমতার দাপট আর দম্ভ অসহায় নাগরিকদের চোখ এড়ায় না। তারা কী আর করতে পারে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়া ছাড়া! সেখানে সমালোচনা বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেই জনগণ তাদের রাগ-ক্ষোভ হালকা করছে। ভিআইপিদের মোটা চামড়া ভেদ করে তা এত দিনে গায়ে লেগেছে বলে মনে হয়। তাঁরা সম্ভবত উল্টো পথে আর যেতে চান না। তাঁরা নিজেদের জন্য রাস্তায় আলাদা লেন চান। অবস্থাটা তাহলে দাঁড়াবে কী? ভিআইপি লেন করা মানে আমাদের রাস্তাগুলো আরও সরু হবে। আমরা যারা সাধারণ জনগণ, তাদের বিপদ আরও বাড়বে, আরও বেশি সময় যানজটে আটকে থাকতে হবে। আর নিজেদের লেন দিয়ে ‘ভিআইপিরা’ চলে যাবেন!

প্রস্তাবটি এসেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। এর পেছনের যুক্তিটি ব্যাখ্যা করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। ‘আমাদের এখানে ভিআইপিদের গাড়ি অনেক সময় উল্টো পথে যায়, এ নিয়ে নানান ঝামেলা হয়।’ ভাবটা এমন যে ভিআইপিদের উল্টো পথে যাওয়া ঠেকাতে হলে তাঁদের জন্য আলাদা লেন করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাঁকে প্রশ্ন করতে চাই, ভিআইপিরা উল্টো পথে যান কেন? দেশের আইন বা সংবিধান কি তাঁদের সেই অধিকার দিয়েছে? মনে প্রশ্ন জাগে, এমন একটি লেন যদি ঢাকার রাস্তাগুলোতে বানানো হয়, তবে সেই লেনে চলতে পারবেন এমন ভিআইপিদের তালিকায় কাদের কাদের জায়গা হবে? মন্ত্রী-সাংসদদের সঙ্গে সচিব-আমলাদেরও? মন্ত্রী-সাংসদেরা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, জনগণের সেবা করাই তাঁদের কাজ। আর সচিব ও আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁরা যদি ভিআইপি লেন দিয়ে চলাচল শুরু করেন, তাহলে তাঁরা কি আর জনগণের সেবক বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী থাকছেন, নাকি জনগণের সামনে প্রভু হিসেবে হাজির হচ্ছেন!

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যাঁদের মাথা থেকে ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন করার ধারণা এসেছে, তাঁদের উদ্দেশে বলি, ভিআইপি কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়। মন্ত্রিত্ব, সাংসদ বা আমলাগিরি-সবকিছুরই মেয়াদ আছে। এখন যাঁরা ভিআইপি লেনে চলবেন বলে স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরাও কিন্তু একসময় ‘সাধারণ জনগণে’ পরিণত হবেন। তখন ভিআইপি লেনের পাশে যানজটে আটকে থেকে কিন্তু মাথার চুল ছিঁড়তে হতে পারে। একসময় ‘ভিআইপি’ ছিলেন এমন অনেকেই কিন্তু এখন আমজনতার জীবন যাপন করছেন। ঢাকার জনসংখ্যা কত, তার খুব বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই। এই সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ থেকে দেড় কোটি পর্যন্ত ধরা হয়। এর মধ্যে ভিআইপির সংখ্যা কত? আর ভিআইপি লেন বানাতে ঢাকার সড়কের কত ভাগ জায়গা লাগবে? যাঁরা এই প্রস্তাব তৈরি করেছেন তাঁরা কি বিষয়গুলো একবারও ভেবেছেন?

এক সাংবাদিক বন্ধু ফেসবুকে যানজট নিয়ে তাঁর ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে লিখেছেন, ‘এই শহরের নগর পরিকল্পনাবিদেরা গলায় দড়ি দেয় না কেন?’ যিনি এই মন্তব্য করেছেন, তিনি কতটা হতাশা আর বিরক্তি থেকে তা করেছেন আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু এর দায় কি নগর পরিকল্পনাবিদদের, নাকি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকদের? স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের কাছে এই প্রশ্ন রেখেছিলাম। ঢাকা নগরীর বর্তমান দশা ও যানজটে অচল হয়ে পড়া এই নগরী নিয়ে তাঁরও ক্ষোভের শেষ নেই। বললেন, পরিকল্পনায় তো সবই আছে। বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব যাঁদের, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলারা যদি তা না করেন, তবে পরিকল্পনা দিয়ে কী হবে! দুনিয়ার সেরা নগর পরিকল্পনাবিদ দিয়ে পরিকল্পনা করেও কাজ হবে না, যদি সেই পরিকল্পনা নিয়ম মেনে বাস্তবায়ন করা না হয়। এখন হুট করে ভিআইপি লেনের প্রস্তাব এসেছে, এটা কোন নগর পরিকল্পনাবিদের কাছ থেকে এসেছে? ঢাকা নগরীর কত ভাগ জনগণ এর সুফল পাবে? এমন লেন হলে রাস্তা আরও সরু হবে, যানজট আরও বাড়বে।

মোবাশ্বের হোসেন অনেক উদাহরণ দিলেন। বললেন, আমরা সবাই জানি ঢাকার যানজটকে সহনীয় পর্যায়ে নিতে হলে কী কী করতে হবে। ব্যবস্থাপনার কাজটি ঠিকভাবে করতে পারলে ঢাকার যানজট অন্তত ৫০ শতাংশ কমানো সম্ভব। ঢাকার ফুটপাতকে এমন করতে হবে, যাতে একজন অন্ধও সেই পথে হাঁটতে পারে। ব্যক্তিমালিকানার হাজার হাজার বাস-মিনিবাসের গণপরিবহন ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে হবে। বাস চালাতে হবে একটি-দুটি কোম্পানির মাধ্যমে। ছাল-চামড়া নেই এমন বাসগুলো যাত্রী ওঠাতে যখন প্রতিযোগিতা করে, যেখানে-সেখানে গাড়ি থামায়-তখন সেই শহর যানজটমুক্ত হবে কীভাবে? ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা হয়েছে, সেখানে নানা বিষয় আছে। তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না অথচ এখন ভিআইপি লেনের কথা বলা হচ্ছে।

ঢাকা শহরে বেশ কিছু ফ্লাইওভার হয়েছে। কিন্তু এগুলো যানজট কমাতে কী ভূমিকা রাখছে? কত শতাংশ মানুষ এর ফল পাচ্ছে? স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন জানালেন, ২ থেকে ৩ শতাংশ মানুষ এর সুফল ভোগ করে। তাঁর ভাষায়, ঢাকা সম্ভবত দুনিয়ার একমাত্র শহর, যেখানে একেকটি ফ্লাইওভার একেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বানিয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ গোপনে পরিকল্পনা করে ও বাস্তবায়ন করে। কারণ, এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা জেনে গেলে প্রকল্প নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতে পারে।

এসব উড়ালসড়ক যে খুব বিচার-বিবেচনা ও পরিকল্পনা করে হয়নি, তা এরই মধ্যে আমরা টের পেতে শুরু করেছি। মৌচাক-মগবাজার উড়ালসড়কের কারণে তেজগাঁও-মগবাজার ও রামপুরা-মৌচাক রুটের বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বাতিল হয়ে যেতে পারে। হানিফ ফ্লাইওভারের কারণে মেট্রোরেল যাত্রাবাড়ীর পরে আর সম্প্রসারণ করার সুযোগ থাকবে না। স্থপতি মোবাশ্বের কৌতুক করে বললেন, ‘সরকার ঢাকা শহরকে স্যুট পরাতে চেয়েছে, শার্ট ও কোট নিয়ে চিন্তাভাবনার আগে শুরুতেই টাই পরিয়েছে, আর এখন দেখা যাচ্ছে প্যান্টও নেই। ভাবটা এমন যে প্যান্টের কথা পরে ভাবলেও হবে।’

ঢাকা শহরের সামগ্রিক নগর বা পরিবহন পরিকল্পনায় সমন্বয়হীনতার বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামছুল হকের সঙ্গে এ নিয়ে বিভিন্ন সময় অনেক কথা বলেছি। তিনি সব সময়ই সমন্বিত পরিবহনব্যবস্থার কথা বলেন। সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য বহুমাত্রিক গণপরিবহনব্যবস্থার কথা বলেন। কিন্তু সরকারের কাজকর্মে গণপরিবহন বা সাধারণ মানুষ তাদের বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না। ফ্লাইওভার হয়, কিন্তু বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট গুরুত্ব পায় না। ব্যক্তিমালিকানার বাস সার্ভিসের বদলে কোম্পানিভিত্তিক বাস চালু করা যায় না। গত সোমবার তাঁর সঙ্গে আবারও কথা হলো। ঘুরেফিরে আবার সেই সমন্বয়হীনতার কথা এল। বললেন, ঢাকাকে দেখার একক কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় এই শহর নিয়ে কারও আসলে কোনো দায় নেই। বিমান ওঠানামার জন্য বিমানবন্দর হয়েছে, ঢাকায় লঞ্চ ভেড়ানোর জন্য লঞ্চ টার্মিনাল হয়েছে। কিন্তু এসব জায়গায় যাত্রীরা কীভাবে আসা-যাওয়া করবে, তা দেখবে কে?

আসলে আমরা এমন এক ‘উন্নয়ন’ হুজুগের মধ্যে গিয়ে পড়েছি, কে কাকে বোঝাবে যে পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন উন্নয়ন নয়। অবকাঠামো তৈরি করা মানে উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন মানে এমন অবকাঠামো বানানো, যা কাজে লাগে। উন্নয়নে বহুমাত্রিকতা লাগে, খেয়াল রাখতে হয় একটি অবকাঠামো যাতে অপরটির পরিপূরক হয়। আর শুধু অবকাঠামো বানালেই হয় না, ঠিকমতো এর ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে অবকাঠামো একটি পরিত্যক্ত বিষয় ও বোঝায় পরিণত হয়।

সমন্বিত পরিকল্পনা, গণপরিবহনব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া, একক ও শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঢাকার উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ-ঢাকার ব্যাপারে এসব পরামর্শ নতুন নয়। সমস্যাটি তাহলে কার? এসব পরামর্শ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব যাঁদের, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের। কিন্তু ঢাকা কি আদৌ তাঁদের চিন্তার মধ্যে আছে? স্থপতি মোবাশ্বের ক্ষোভ নিয়ে বললেন, ‘একটি সন্তানের যদি ৫৪ জন অভিভাবক হয়, তবে সেই সন্তানের যে দুর্দশা হওয়ার কথা, ঢাকারও তা-ই হয়েছে। ৭ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫৪ সংস্থা ঢাকার দেখভাল করে। ঢাকার যদি একজন পিতা হতো, তাহলে শহরের এই অবস্থার জন্য তাঁকে আমরা বিচারের মুখোমুখি করতে পারতাম। আমরা এখন কাকে ধরব?’

৫৪ অভিভাবকের বদলে ঢাকা এক অভিভাবক কবে পাবে? মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও ঢাকার রাস্তায় কী করতে হবে সেই পরামর্শ আসে! এমন পরামর্শ বাস্তবায়ন হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ঢাকা তো জনগণের নয়, ভিআইপিদের। ঢাকা তবে ভিআইপিদেরই হোক! তাঁরা ঠিকমতো চলতে পারলেই তো হলো। হয় উল্টো রাস্তায় অথবা আলাদা লেনে।

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
[email protected]