স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধের ৭৫ বছর, অতঃপর...

ভলগার তীরঘেঁষা সেই ঐতিহাসিক স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধই থামিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় তথা বিশ্বসভ্যতার পতন। ৭৫ বছর আগে ১৯৪৩ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী প্রায় পুরো ইউরোপ দখল করে, আরও আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের ককেশাস অঞ্চল দিয়ে এগিয়ে মস্কো দখলের অভিপ্রায়ে স্তালিনগ্রাদ শহরকে কবজায় আনতে চেয়েছিল।

এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে উদ্যাপিত হচ্ছে নাৎসিদের বিরুদ্ধে বীর সোভিয়েত জনগণ ও লাল ফৌজের স্তালিনগ্রাদ বিজয়ের ৭৫ বছর। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধই ছিল চূড়ান্ত যুদ্ধ। সাড়ে ছয় মাস ধরে স্তালিনগ্রাদ শহর ঘিরে চলা এই যুদ্ধ ছিল নৃশংস আর ভয়াবহ। স্তালিনগ্রাদ পতনের পরই নাৎসি বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। আর আরও দুই বছর পর ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিস্ট জার্মানির কবর রচনার শুরুটাই ছিল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ।

তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আজ এত দিন পর সোভিয়েত রাষ্ট্র ও ইউরোপের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। যে পূর্ব ইউরোপের পথ ধরে সোভিয়েত লাল ফৌজের সেনানীরা বার্লিনের দিকে এগিয়ে এসে শহরের কেন্দ্রে ভিলহেলম আর ফস সড়কের কোনায় অবস্থিত হিটলারের শেষ আশ্রয়স্থল গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, সেই পথ ধরেই যেন এগিয়ে আসছে নব্য ফ্যাসিস্টদের আত্মা।

১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এই ১২ বছরের হিটলার জামানায় জার্মানিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী স্বল্পসংখ্যক প্রতিবাদী গোষ্ঠী ছিল। তাদের সংখ্যা ও শক্তি ছিল খুবই নগণ্য। অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ ফ্যাসিবাদবিরোধী গোষ্ঠীকে হয়তো প্রবাসে অথবা হিটলারের বন্দিশিবিরে মৃত্যুর দিন গুনতে হয়েছিল। একটি বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা সব সময় একমত, হিটলারবিরোধী মিত্র শক্তির বাহ্যিক মৈত্রী এবং রণকৌশলের কারণে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর এই বর্বরতম ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন ঘটেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের কারণে তাদের দুই কোটি লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। এত দিন জোসেফ স্তালিনের সেনাপতিদের দক্ষতা এবং জেনারেল জুকোভের বার্লিন যুদ্ধের বিজয়কৌশল মানুষের মুখে মুখে ছিল। এরপরও ১৯৩৯ সালে হিটলার-স্তালিনের গোপন শান্তিচুক্তির প্রচেষ্টার কারণে কিছু অপ্রকাশিত রহস্য যে থাকতে পারে, এটা অনেকের ধারণাই ছিল। তবে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য স্তালিন সংগত কারণেই একটি দ্বিমুখী কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই চুক্তির বলে পোল্যান্ডের পশ্চিম অংশ জার্মানি ও পূর্ব অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে চলে যাওয়া এবং দুই অংশেই হিটলার ও স্তালিনের সেনাবাহিনীর হাতে দুই লাখ মানুষের নিহত হওয়ার কথা এখন জানা ইতিহাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানির বিভক্তি হিটলারের ফ্যাসিবাদী যুদ্ধের ফল। যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে এবং জার্মান জাতির প্রতি যে অবিশ্বাসবোধের জন্ম হয়েছিল, তার রেশ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পূর্ব-পশ্চিম পুঁজিবাদ আর সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্তি হয়েছিল। ১৯৯০ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ তথা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। এরপর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর পুঁজিবাদী পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং ন্যাটো সামরিক জোট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য তাদের তাড়াহুড়োর বিষয়টিও ছিল বিস্ময়কর। বিষয়টিতে পশ্চিমাদের উৎসাহ থাকলেও ততোধিক উৎসাহ ছিল পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর। দীর্ঘ সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দেশগুলোর হঠাৎ পশ্চিমে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি তখন থেকেই রাশিয়া ভালো চোখে নেয়নি।

অধিক গণতন্ত্র, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও মানবিক মূল্যবোধের কথা বলে সমাজতান্ত্রিক শিবির থেকে বেরিয়ে এলেও তারা এখন ক্রমেই স্বৈরাচারী ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারা ইউরোপে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক কট্টরবাদী শক্তি কমবেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও ইউরোপের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের দেশগুলোতে এই প্রবণতা প্রবল। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কসোভো, বুলগেরিয়ায় আইনি প্রক্রিয়াসমূহ এখন ক্ষমতাসীনদের হাতে কুক্ষিগত। সেখানে সংবাদমাধ্যমকে অধিক নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের প্রতি অগণতান্ত্রিক আচরণ, শরণার্থীদের গ্রহণে অস্বীকৃতিসহ তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ এবং বিরোধী দলের প্রতি দমননীতির মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মাত্র ২৮ বছর আগে যাদের মুখে ছিল অধিক গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বুলি, তারা ক্রমেই কট্টর জাতীয়তাবাদী ও স্বৈরাচার হয়ে উঠছে।

পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়ায় বিচারব্যবস্থা আংশিকভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সেখানে রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের ভারসাম্য নষ্ট করা হয়েছে। রোমানিয়ায় সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির তদন্তে বাধা সৃষ্টির জন্য কৌঁসুলিদের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। পোল্যান্ডের আইন মন্ত্রণালয় এখন দেশটির বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতা পেয়েছে। এই মন্ত্রণালয় এখন ক্ষমতাসীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিচারক নিয়োগে সক্ষম। হাঙ্গেরিতে ক্ষমতাসীন কট্টরবাদী ভিক্টর উরবানের জবিক পার্টি সংবিধান পরিবর্তন করে আইনব্যবস্থার স্বাধীনতা ছেঁটে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, দলটি পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার বয়সও হ্রাস করেছে। বুলগেরিয়া ও সার্বিয়া অনেক দিন থেকে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কথা বললেও হামেশাই দেশ দুটির আইন ও বিচারব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।

খোদ জার্মানিতেই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে নব্য নাৎসি দল ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটি পার্লামেন্টে ৯২ আসন নিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

হিটলারের অধিকৃত পোল্যান্ডের কুখ্যাত আউৎসুউজ বন্দিশিবির মুক্তি দিবস উপলক্ষে গত ৩১ জানুয়ারি জার্মানির পার্লামেন্টে স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন আউৎসুউজ বন্দিশিবিরের সাবেক যুদ্ধবন্দী ৯২ বছর বয়সী আনিতা লাস্কার ভালফিস। সাংসদদের সামনে তিনি বন্দিশিবিরে তাঁর মা-বাবাকে হারানোসহ দুঃসহ জীবনের কথা স্মরণ করেন। তাঁর বক্তব্য শেষে সাংসদেরা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে আনিতাকে সম্মান জানালেও সদ্য নির্বাচিত নব্য নাৎসি ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটির ৯২ জন সাংসদ নির্বিকারভাবে তাঁদের আসনে বসে থকেন।

গত শতাব্দীর স্বৈরাচার হিটলারকে রুখতে ৭৫ বছর আগে ঐতিহাসিক স্তালিনগ্রাদ রক্ষার যুদ্ধে অগণিত সোভিয়েত দেশপ্রেমিকসহ সর্বমোট প্রায় সাত কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। অথচ আজ এত দিন পর অতীত ইতিহাস আড়াল করে ইউরোপের দেশে দেশে হিটলারের নিয়মনীতির অপ্রকাশ্য অনুসারীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার প্রতিনিধি
[email protected]