ঘোর অশান্তিতে শান্তির দ্বীপ

প্রধান বিচারপতি, শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন বিরোধী নেতা এবং নিজের সৎভাই সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকে আটক করার আদেশ দেওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, এই অবস্থার জন্য তিনি নন, ‘অন্য লোক’ দায়ী। প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘আমাকে এই পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের জবাবদিহি ধরে রাখতে আর কোনো পথ খোলা নেই। তাই আমি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছি।’

ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপ নামের এই দ্বীপপুঞ্জ যে গুটিকয় কারণে পরিচিত, সেগুলো হলো স্বচ্ছ ও জ্বলজ্বলে দ্যুতি ছড়ানো সাগর, জমকালো ডুবুরিবান্ধব জগৎ, নয়নাভিরাম আইল্যান্ড রিসোর্ট এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এখানকার উত্তেজনাহীন নির্ঝঞ্ঝাট রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে দেশটির সার্বিক পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠেছে। মালদ্বীপের কথা উঠলেই সবাই বলছে, সেখানে এখন দুই পক্ষে ধুন্ধুমার লেগে গেছে। এক পক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন এবং অন্য পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারবিরোধীরা।

সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ নির্বাসিত হওয়ার পর থেকে রাজনীতিতে বড় ধরনের অস্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করে। সেটি এখন তীব্র অবস্থায় রূপ নিয়েছে। মঙ্গলবার বেলা তিনটা নাগাদ কয়েকটি বড় ঘটনা ঘটে গেল। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনী হুড়মুড় করে সুপ্রিম কোর্ট ভবনে ঢুকল। মোট পাঁচ বিচারপতির মধ্য থেকে তারা প্রধান বিচারপতি ও অপর এক বিচারপতিকে ধরে হাজতে নিয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে এই বাহিনী পার্লামেন্ট ভবন ঘিরে ফেলল। কোনো পার্লামেন্ট সদস্যকে অধিবেশনে যেতে দিল না।

এই সামরিক কায়দার দক্ষযজ্ঞের ঘণ্টা কয়েক আগেই প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রেখেছিলেন। তার মানে, সব ধরনের সাংবিধানিক অধিকার স্থগিত করে যাকে-তাকে যখন-তখন গ্রেপ্তার করার অধিকার নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে সৌদি আরব ও চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ইয়ামিন এরপর কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন, সেটা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ইয়ামিনের এই দমননীতির কড়া সমালোচনা করেছে। ভারত বলেছে, এসব ঘটনাপ্রবাহ তাদের ‘পীড়া দিচ্ছে’। মালদ্বীপের দুর্নীতিবিরোধী গ্রুপ ‘ট্রান্সপারেন্সি মালদ্বীপ’-এর প্রকল্প সমন্বয়ক আহমেদ দোলাল বলেছেন, ‘আমরা এখন গণতন্ত্রকে পুরোপুরি ধ্বংস করার পথে চলে এসেছি।’ তিনি মনে করেন, মঙ্গলবার রাতে নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে দেশজুড়ে ধরপাকড় করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তা সেনা অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিকেও হার মানাবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ছোট্ট দেশটিতে এটিই যে প্রথম রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘটনা ঘটল, তা নয়। দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম ও একমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদকে সরানোর মধ্য দিয়ে এই উত্তেজনার শুরু। ২০১২ সালে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্য তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দিলেও বর্তমানে তিনি শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ইতিমধ্যেই তিনি মালদ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানী মালে ছিল থমথমে। এক অজানা আতঙ্ক পুরো জনজীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ইয়ামিন তাঁর বিরোধী অনেককে আটক করে রেখেছেন। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে তাঁদের ছেড়ে দিতে বলেন এবং বিরোধী রাজনীতিকদের সাজার আদেশকে অকার্যকর ঘোষণা করেন। কিন্তু সেই আদেশ মানার পরিবর্তে নিরাপত্তা বাহিনী গণহারে আটক করা শুরু করে।

৫৮ বছর বয়সী ইয়ামিন কখনোই জনপ্রিয় রাজনীতিক ছিলেন না। অনেকের সন্দেহ, বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার নিয়ে তাদের হাতে একটি দ্বীপ বেচে দেওয়ার জন্য তিনি একটি গোপন চুক্তি করেছেন। আরও যে বিষয়টি পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছে, সেটি হলো সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির অনেকের ধারণা, বিরোধীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে বিচারপতিরা এই রায় দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনও তাঁর ভাষণে এ রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই বিচারপতিরা অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করছিলেন।

যে তিন বিচারককে ধরা হয়নি, তাঁরা মঙ্গলবার রাতে প্রেসিডেন্টের পক্ষে দাঁড়িয়ে এক আদেশে বলেছেন, রাজনৈতিক বন্দীদের ছাড়া হবে না এবং যাঁদের সাজা হয়ে গেছে, সেই সাজা বহাল থাকবে। যদিও জনগণের একটি বড় অংশ মনে করে, সরকারের চাপে পড়ে তাঁরা এই আদেশ জারি করেছেন। এখন শেষ পর্যন্ত ইয়ামিন পরিস্থিতি কতক্ষণ নিজের দখলে রাখতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জেফরি জেটলম্যান: নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়ার ব্যুরোপ্রধান

সুহাসিনী রাজ: নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক