ফাঁস প্রশ্ন 'ভুয়া' কেন? জবাব চাই

ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। স্কুলের নাম ইসলামী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা ছিল সেদিন। সকালবেলা ফাঁস হওয়া এমসিকিউ পেয়ে যান কজন অভিভাবক। তখন তাঁদের সন্তানদের হাতে উত্তর লেখা কাগজ তথা নকল দিয়ে দেন যোগ্য অক্লান্ত কর্তব্যপরায়ণ অভিভাবক। সন্তানেরা পরীক্ষার হলে ঢুকে সেই নকল দেখে দেখে বৃত্ত ভরাট করে।

পরীক্ষা শেষে তারা বাইরে আসে। তখন অভিভাবকেরা দেখেন, প্রশ্নপত্র মেলেনি। সন্তানেরা তাঁদের দেওয়া ভুল উত্তর দিয়ে এসেছে পরীক্ষার খাতায়। এত বড় অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা ঘেরাও করেন প্রধান শিক্ষকের দপ্তর। আমাদের সন্তানদের আবারও এমসিকিউ অংশের পরীক্ষা দিতে দিন। দিতে হবে দিতে হবে। আমাদের দাবি মানতে হবে।

প্রধান শিক্ষক বেরসিক। জানিয়ে দেন, প্রশ্নের উত্তর সিলগালা হয়ে গেছে। আর সম্ভব নয়।

এবার বুঝুন অবস্থা! এই অভিভাবকদের লইয়া আমরা কী করিব?

আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে দুষি, আমরা যখন বলছিলাম প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, বহুদিন তিনি অস্বীকার করেছেন।

তারপর তিনি বললেন, কতিপয় নীতিহীন শিক্ষক এই কাণ্ড করেন। হলে প্রশ্নপত্র পৌঁছে যাওয়ার পর তাঁরা ছবি তুলে অনলাইনে প্রকাশ করে দেন। আর আকাশে চাঁদ উঠলে যেমন তা গোপন করা যায় না, একবার প্রশ্নপত্র কপি হলে তা আর চাপা থাকে না। গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে।

আমরা দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কোচিং সেন্টারের কর্মী, প্রেসের কর্মচারী-নানাজন আটক হচ্ছেন। আমরা এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স চাই, দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।

কিন্তু আমরা তো বিশ্ব রেকর্ড করেই ফেলেছি। আমরা ক্লাস ওয়ানের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি, ক্লাস টুর করেছি, মাধ্যমিকেরটা করেছি, উচ্চমাধ্যমিকের করেছি, মেডিকেলে ভর্তিরটা করেছি, ব্যাংকের অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষারটা করেছি। আমাদের এই রেকর্ড চির অক্ষয়, কারও বাবা বা নাতির সাধ্য নাই এই রেকর্ড ভঙ্গ করে।

কিন্তু এ জন্য কে দায়ী? শিক্ষামন্ত্রী তো মেডিকেলের প্রশ্নপত্রের দায়িত্বে নন। ব্যাংকের প্রশ্নের দায়ও তাঁর নয়। তাহলে?

ফাঁসের জন্য দায় খুঁজে লাভ নেই। ফাঁস না হওয়ার দায় কার, সেটা বরং খোঁজা যায়।

এখন বলুন গফরগাঁওয়ের স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হয়নি, এ জন্য কে দায়ী? কজন অভিভাবক যে তাঁদের সন্তানদের ভুয়া প্রশ্ন দেখে ভুয়া উত্তরের নকল সরবরাহ করলেন, তার দায় কার?

কাজেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া রোধের উপায় পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গোটা দশেক প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীকে নিয়োগ দেবে। তারা পরীক্ষার আগের রাতে ভুয়া প্রশ্নপত্র বানিয়ে ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দেবে। ১০ সেট নকল প্রশ্ন। কোনটা রেখে কোনটা পড়ি? আর যদি না মেলে? তার চেয়ে বই পড়, ওরে হারামজাদা, নকলের পেছনে ছুটিসনে। মূল বই পড়।

এই হতে পারে আমাদের নীতিনৈতিকতা ধসে পড়া অভিভাবকদের জন্য একমাত্র দাওয়াই। সত্যি সত্যি এটা করুন। আমি এটা জেনেশুনে বুঝে বলছি, নকল দশটা প্রশ্ন আগের রাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক, কিন্তু গোপন ব্যবস্থা করুন।

তাতে যদি নৈতিকতায় বাধে, তাহলে ৫ সেট ১০ সেট প্রশ্ন করুন। সেটা গোপনও রাখতে পারেন, বছরের শুরুতে প্রকাশও করে দিতে পারেন। সেই সব প্রশ্নপত্রে বছরের শুরুতে সিরিয়াল থাকবে ক, খ, গ। আর হলে যখন যাবে, তখন সিরিয়াল হবে পদ্মা মেঘনা যমুনা।

পরীক্ষার সকালে হলে হলে, ইউএনওকে, ডিসিকে, থানা শিক্ষা অফিসারকে এসএমএস করে, ই-মেইল করে জানিয়ে দেবেন এবারের পরীক্ষা হবে তিস্তায়। আর বিভিন্ন বোর্ডে বিভিন্ন সেটে পরীক্ষা হবে।

সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবেন কোথা? আমাদের সমষ্টিগত নৈতিকতায় দাবানল লেগেছে। আমরা শিক্ষা বলতে জ্ঞান অর্জন বুঝি না, দক্ষতা অর্জন বুঝি না, নীতিনৈতিকতা তো বুঝিই না।

আমাদের অভিভাবকেরা কি বুঝছেন যে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নকল সরবরাহ করে ‘চুরি’ শিক্ষা দিচ্ছি? আমরা হয়ে উঠছি ‘চোরের বাবা’ ‘চোরের মা’?

তবু বলব, সিস্টেম বা ব্যবস্থা ঠিক হলে মানুষ ঠিক হয়। মন সহজে কি আর সই হবা, চিরদিন ইচ্ছা এমন আল ডিঙায়ে ঘাস খাবা। কাজেই ব্যবস্থাটাকেই নিশ্ছিদ্র করতে হবে। এরশাদ আমলে একবার পরীক্ষার হলে স্লোগান শুনেছিলাম, ভোট হয়েছে যেভাবে, পরীক্ষা হবে সেভাবে।

কাজেই আমাদের ব্যবস্থা বা সিস্টেমকে ত্রুটিমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। সেটা সর্বক্ষেত্রেই।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক।