খালেদা নির্বাচনে যেতে পারবেন?

দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ঢাকা, ৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো
দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ঢাকা, ৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে আদালত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এই রায় তাঁর প্রায় চার দশকের বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের ওপর কী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, এ মুহূর্তে সবার মনে সেই প্রশ্ন। আগামী সাধারণ নির্বাচনের এক বছরও বাকি নেই। এ সময়ে ক্ষমতাসীন দল যখন নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে, তখন বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার সাজা লাভের ঘটনার সম্ভাব্য আইনি ফল কী হতে পারে, জনমনে তা নিয়ে এখন প্রচণ্ড কৌতূহল।

দুর্নীতির দায়ে দণ্ডের কারণে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্নে সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যায় সাম্প্রতিক কালে নতুন ব্যাখ্যা এসেছে। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল বলেছেন, রায় আছে দুটি। আপিল চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত একটি রায় বলছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে, অন্যটি বলেছে যাবে না।

সংবিধানের ৬৬ (২ গ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাবাসে থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে যোগ্য হবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, দুর্নীতির মামলায় শাস্তিলাভের পর রাজনীতিকদের সংসদে রাখা না-রাখার ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে রাজনীতিই বড় বিবেচ্য হয়ে ওঠে। বিএনপি আমলে জনতা টাওয়ার দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার সাত বছর পরে ২০০০ সালে এরশাদ সংসদে অযোগ্য হন। খালেদা জিয়া তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ব্যথিতচিত্ত এরশাদের বাড়িতে যান। বিএনপির চারদলীয় জোট এরশাদের সাংসদ পদ খারিজের নিন্দা করে। প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এসব খালেদা জিয়ার অসততা।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা জামিন চাইব। আপিলে দণ্ড স্থগিত চাইব কি না, সে কৌশল ঠিক করব তাঁর মুক্তির পর।’ তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায়গুলোতে অস্পষ্টতা আছে। আরেকটু বিশদ করে তিনি বলেন, ফরিয়াদির জন্য জামিন পেলে দণ্ড স্থগিত চাওয়া লাভজনক, না পেলে দণ্ড স্থগিত চাওয়া ক্ষতিকর। কারণ, তখন তা মঞ্জুর হলে দণ্ডিতের সম্ভাব্য কারাবাসের দিনগুলো পরে তাঁর সাজা খাটা দিন হিসেবে গণ্য হওয়ার পথ রোধ করতে পারে। আবার শুধু আপিল আবেদন গৃহীত হয়ে দণ্ড বহাল থাকলে নির্বাচনে তাঁর অযোগ্যতার প্রশ্ন উঠতে পারে।

আইনমন্ত্রীর বরাত দেওয়া রায় দুটির একটি আপিল বিভাগের, আরেকটি হাইকোর্টের। ১৯৯৬ সালে আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেছিলেন, এ ধরনের অযোগ্যতার প্রশ্ন ঠিক হবে ভোটের পরে, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে। রিটার্নিং অফিসার মনোনয়ন বাতিল করলেও রিট চলবে না।

হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন, বিচারিক আদালতে কেউ দণ্ডিত হওয়ামাত্রই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার (কনভিকশন) বিষয়টি স্থগিত করার কোনো ক্ষমতা আপিল আদালতের হাতে নেই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাস্তবতায় ব্যক্তিভেদে এর বিচিত্র প্রয়োগ ঘটেছে।

পাঁচ বছরের দণ্ড হওয়ায় কেউ কেউ যখন খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য করার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, তখন তার ভিন্ন নজিরও চোখের সামনে আছে। ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী এবং ‘ইয়াবা সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত আবদুর রহমান বদি দণ্ড মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব ও সাংসদ পদ ধরে রেখেছেন। মায়া অবৈধভাবে ৬ কোটি টাকা অর্জনের মামলায় ১৩ বছর দণ্ডিত হয়েছিলেন। আপিল বিভাগের রায় অনুসারে ২০১৫ সালের ১৪ জুন থেকে তাঁর সাংসদ ও মন্ত্রী পদ শূন্য হওয়ার কথা। কিন্তু মায়া পদ দুটিতে দিব্যি বহাল আছেন। তাঁর মামলার অন্যতম আইনজীবী সাঈদ আহমেদ ইতিপূর্বে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘পুনঃশুনানি হলে নিম্ন আদালতের রায় কীভাবে বহাল থাকবে?’ এর আগে সর্বোচ্চ আদালতে বেকসুর খালাস না হওয়া সত্ত্বেও মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। আপিল বিভাগের রায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন তাঁর আসন শূন্য ঘোষণা করার পরও তাঁর মন্ত্রিত্ব টিকে ছিল।

প্রবীণ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর বিশ্বাস, আপিল আবেদন গ্রহণই বড় বিষয়। যতক্ষণ সেটি চলবে, ততক্ষণ শাস্তি বা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপরটি চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে না। এই যুক্তিতে মায়ার মন্ত্রিত্ব তিনি বৈধ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, খালেদা জিয়াও আপিল করে নির্বাচন করতে পারবেন।

খালেদা জিয়ার আইনি পরিণতি তাহলে কোনটা? আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এখন ওনার (খালেদা জিয়া) ব্যাপারে আপিল বিভাগ এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তাদের বিষয়।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য তিনি উপযুক্ত লোক নন। তবে এ তথ্যটি তিনি নিশ্চিত করেছেন যে মেয়ের বিয়েতে শতাধিক গরু জবাই করে আলোচিত ময়মনসিংহের জাতীয় পার্টির সাংসদ সালাহ উদ্দিন আহম্মেদের বিষয়ে তাঁদের পাঠানো পত্রের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এখনো নীরব। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ নিজের সহায়সম্পদ দেখিয়েছিলেন সাড়ে চার লাখ টাকার, কিন্তু সে বছরই তিনি ৫৯ লাখ টাকার আয়কর দেন। অসত্য হলফনামা জমা দেওয়ার পরও ইসি তাঁর পদ শূন্য ঘোষণা করেনি।

নতুন রায়
২০১৭ সালের ৯ মে মো. মামুন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মো. খুরশিদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ‘দোষী সাব্যস্ত’, ‘দণ্ড স্থগিত’ এবং ‘দণ্ড কার্যকরণ স্থগিত’ হওয়ার মধ্যে প্রভেদ সুনির্দিষ্ট করে একটি রায় দেন। তাতে স্থির করা দিকনির্দেশনায় বলা হয়, ‘নিম্ন আপিলাত আদালত’-এর এখতিয়ার কেবল দণ্ড স্থগিত করার। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কার্যকারিতা স্থগিত করার ক্ষমতা তাঁর নেই। মামলাটির অন্যতম অ্যামিকাস কিউরি প্রবীর নিয়োগী এ মত দিয়েছিলেন। আরেক অ্যামিকাস কিউরি খুরশিদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিকনির্দেশনায় ‘নিম্ন আপিলাত আদালত’ বলতে হাইকোর্টকে বোঝাচ্ছে। এর তাৎপর্য, আপিল আবেদন গ্রহণ করার মাধ্যমে খালেদা জিয়ার ‘দোষী সাব্যস্ত’ হওয়া স্থগিত করার এখতিয়ার হাইকোর্টের থাকবে না।

জনতা টাওয়ার
জনতা টাওয়ার মামলায় ১৯৯৩ সালে সাত বছরের দণ্ড পাওয়ার সাত বছর পরে আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ বছরটিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষিত হয়েছিল। এরশাদ এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে ২০০১ সালের ২১ মে বিচারপতি জয়নাল আবেদীন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ৬৬ (২) গ-তে বর্ণিত শর্তের আলোকে কারাদণ্ড কী, তার ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা পরস্পরবিরোধী মত দিয়েছিলেন। জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন, আপিল বিভাগের মাধ্যমে না বলা পর্যন্ত ‘দণ্ডিত হওয়া’ বোঝাবে। খায়রুল হক মত দিয়েছিলেন, কেউ বিচারিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ামাত্রই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। গত সপ্তাহে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, তিনি তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গি এখনো যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করেন। দোষী সাব্যস্ত হওয়ামাত্রই কারও অযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাচন কমিশনে মতৈক্য রয়েছে।

জিয়াউর রহমানের ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী (বর্তমানে জাতীয় পার্টির স্থায়ী কমিটির সদস্য) এ কে এম মাইদুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময়ে দণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও রিটার্নিং অফিসার এরশাদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করায় হাইকোর্টে আমি তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। হাইকোর্ট বলেছিলেন, তাঁর আপিল বিচারাধীন বলে তাঁর মনোনয়নপত্র বৈধ।’

২০১৫ সালে বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টু ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মিহির সারওয়ার মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিন্টু অন্যূন দুই বছর কারাবাসের জন্য দণ্ডিত হয়েছিলেন এবং হাইকোর্ট তাঁর আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করলেও আমরা তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলাম। আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও মাহবুব উদ্দিন যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তাঁর আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। তাই তাঁর মনোনয়নপত্র বৈধ বলে গণ্য হওয়া উচিত। তবে আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, হাইকোর্ট আপিল আবেদন গ্রহণ করলেও বিচারিক আদালতের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেননি। তাই তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে।’

স্বাধীনতার আগের ও পরের বাংলাদেশের ইতিহাস রাজনীতি ও আইন পরস্পরের ওপরে নানা সময়ে নানা ছায়া ফেলেছে। পাকিস্তান আমলে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলোর অভিজ্ঞতা এখন ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু এক-এগারোর পরিহাস সবার স্মৃতিতেই তরতাজা। সেনা-সমর্থিত সেই সরকারের আমলে দুদকের মামলাগুলো ‘মিথ্যা’ বিবেচনায় নিয়ে সরকারি দলের নেতারা নির্বিচারে দায়মুক্তি নিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারই চলতে দেওয়া হলো না। তাই ঘুরেফিরে রাজনীতিই শেষ কথা। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক-রাজনীতিই তার পথ বাতলাবে।