আফগান নীতির পরিণতি ভয়াবহ

এএফপি । ফাইল ছবি
এএফপি । ফাইল ছবি

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সম্প্রতি একটি ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছেন। তাঁরা এখন স্বীকার করছেন, জিহাদকেই যারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল নিয়ামক বলে জানে, সেই উগ্র জিহাদি নেটওয়ার্ককে জেনারেল জিয়া মদদ দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে আশির দশকে একটা ‘ফ্যাসাদ’ বাধিয়েছিলেন।

শুধু তা-ই নয়, নাইন-ইলেভেন হামলার পর জেনারেল মোশাররফের গ্রহণ করা ‘এনলাইটেন্ড মডারেশন’ থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ‘জারব-এ-আজাব’ ও ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান (এনএপি) এবং ২০১৬ সালের অপারেশন ‘রাদুল ফ্যাসাদ’ পর্যন্ত—সব কার্যক্রমেই সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা ‘ফ্যাসাদ’ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিভাগ সেই নিকৃষ্ট আফগান নীতি এখনো ধরে আছে।

আফগান সরকার এবং দেশটির মূলধারার সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে তালেবানকে সহায়তা দেওয়াই মূলত এই নীতির লক্ষ্য। কিছুদিন আগেও তালেবান মূলধারার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করার ভান করত। কিন্তু সম্প্রতি আফগানিস্তানে বেশ কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করে তালেবান নেতারা সেই ছদ্মবেশ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এর ফলে আফগানদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা এবং এই অঞ্চলে উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাস অনন্তকাল চলার সুযোগ তৈরি হলো। এর সঙ্গে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে তালেবান মতবাদ ‘রপ্তানি’ চলতে থাকবে। মানে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান এখন কার্যত অকার্যকর ও তথাকথিত নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো কার্যকর রয়েছে এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বিস্তারে ‘মূলধারার’ রাজনৈতিক শক্তিগুলো কাজ করছে।

আফগান নীতি যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা চিরকালই প্রত্যাখ্যানের কৌশল অবলম্বন করে এসেছেন। এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে যে চারটি যুদ্ধ হয়েছে, তার একটিতেও মদদ দেওয়ার কথা পাকিস্তান স্বীকার করেনি। কিন্তু এখন সেই সুযোগ আর নেই। ২০১৬ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে সারতাজ আজিজ খোলামেলা স্বীকার করেন, পাকিস্তানে বহুদিন ধরেই আফগান তালেবান নেতারা ছিলেন, এখনো আছেন। তালেবান রীতি অনুযায়ী, শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাঁদের আমিরকে ঘিরে থাকেন। সেই দিক থেকে সারতাজ আজিজের বক্তব্য বিবেচনা করলে বলা যাবে, তালেবান আমির পাকিস্তানেই থাকেন এবং তাঁকে থাকতে দিয়েছে সেখানকার সরকার।

গত বছরের পুরোটা সময়ে পাকিস্তান তাদের মাটি থেকে সব ধরনের জঙ্গি হটিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে এসেছে। কিন্তু ওই বছরই আমেরিকান ড্রোন কুররাম এজেন্সি এলাকায় নয়টি এবং ওয়াজিরিস্তান এলাকায় চারটি হামলা চালায়। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ওই হামলায় আফগান তালেবানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হন। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, পাকিস্তানের ভেতরে এখনো আফগান তালেবানের অস্তিত্ব আছে।

এমনকি এ বছরের শুরুতে পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় বেশ কয়েকজন বিদেশি সন্ত্রাসীও নিহত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, কিছু রাজনীতিক আফগান তালেবানের বিরুদ্ধে না যাওয়ার যুক্তি হিসেবে বলেন, এটা করলে পাকিস্তানে আফগান জঙ্গিরা ঢুকে ঝামেলা তৈরি করবে। অথচ তাঁরাই তালেবান নেতাদের পাকিস্তানে আয়েশি জীবনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

খুব অবাক করা ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের কিছু সরকারপন্থী গণমাধ্যমকর্মী ও বিশ্লেষক আফগানিস্তানে তালেবানের ‘সাফল্যে’ খুব খুশি। তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে ‘কাফের’ পশ্চিমা গণমাধ্যমের সংবাদের সত্যতা অস্বীকার করেন। একই পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যখন আফগানিস্তানে তালেবানের তৎপরতা বৃদ্ধির খবর দেয়, তখন এই ‘দেশপ্রেমিক’ লোকগুলোই তালেবানের অপ্রতিরোধ্যতার প্রমাণ হিসেবে সেই খবরকে উদ্ধৃত করে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে তালেবান ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পর এই লোকদের উল্লাস আমাদের নিদারুণভাবে ব্যথিত করে। কিন্তু তাদের এই অদূরদর্শী নীতি পাকিস্তানকে কয়েকটি গুরুতর নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

প্রথমত, গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, আফগানিস্তানে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ উত্থানের কারণে পাকিস্তানে উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাস বেড়েছে। এই অল্প কিছুদিন আগেও কেন্দ্রশাসিত উপজাতীয় এলাকা (ফাটা) স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র শুধু নিয়ন্ত্রণই করেনি; তারা মালাকান্দ বিভাগের কয়েকটি জেলার দখলও নিতে শুরু করেছিল। পেশোয়ার, ইসলামাবাদসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ব্যবসায়ীদের নিয়মিত তালেবানকে চাঁদা দিতে হতো। একটা সময় ছিল, যখন করাচির ৪০ শতাংশ এলাকার দখলে ছিল তালেবান। এমনটা যে আর ঘটবে না, তা কে বলতে পারে? দ্বিতীয়ত, তালেবানের পুনরুত্থানে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। এর ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলে রাশিয়া ও চীনের হস্তক্ষেপ বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে।

তৃতীয়ত, তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের নগ্ন সমর্থন আফগান জনগণের মধ্যে তীব্রভাবে পাকিস্তান বিদ্বেষ তৈরি করবে। বিশেষত, সম্প্রতি আফগানিস্তানে যে হামলাগুলো হলো, সেগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। চতুর্থত, এই দেউলিয়া আফগান নীতি পাকিস্তানের পশতুনদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে। এই নীতির কারণে তাদের মধ্যে বড় ধরনের লড়াই হচ্ছে। তাদের বহু লোকের প্রাণহানি ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে। এসব কারণে পাকিস্তানকে এখনই তার তালেবানবান্ধব আফগান নীতি থেকে সরে আসতে হবে। 

দ্য নেশন থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

আফ্রাসিয়াব খটক পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর ও আঞ্চলিক বিষয়াদির বিশ্লেষক