যে পররাষ্ট্রনীতিতে বামপন্থা নেই

ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কী বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা একবার ভাবুন। উত্তর কোরিয়ার একনায়ককে অপমানসূচক কথা বলে ফায়দা হাসিলের চেষ্টার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতাকালের প্রথম বছরটি পার করলেন। এই সময়টাতে উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্র কার্যক্রম ক্রমেই বাড়িয়েছে; আর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ক্রমান্বয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লাগানোর দিকে এগিয়েছে।

গত বছরের এপ্রিলে কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক আলোচনা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সরকারি ভবনগুলোতে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। হামলার পর কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে প্রাক্‌-পরিকল্পনা ছিল না। ফলে এটি থেকে কোনো ফল আসেনি। একইভাবে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের অস্ত্র দিল। কিন্তু তুরস্ক যখন কুর্দিদের ওপর হামলা চালাল, তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য না করে ঠায় দাঁড়িয়ে লড়াই দেখতে থাকল।

ইরাকের মসুলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের ‘জয়’ ধরে রাখতে ওবামা আমলে সেখানকার আকাশসীমার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে সেনা গুটিয়ে নিল। এরপরই আমরা দেখলাম, সেখানে হাজার হাজার লোক মরল। বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। ভিয়েতনামের মতো একই কায়দায় যুক্তরাষ্ট্র শহরটিকে রক্ষা করতে গিয়ে ধ্বংস করে ফেলল। একই কায়দায় যুক্তিগ্রাহ্য কৌশল মাথায় না নিয়েই ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তানে হাজার হাজার সেনা পাঠিয়ে বসে আছে।

এই ট্রাম্পের আমলে সৌদি আরব থেকে শুরু করে ফিলিপাইনের কর্তৃত্ববাদী সরকারকে পর্যন্ত অন্ধ সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি নির্মাণ আন্দোলন এবং দেশটির ক্ষমতাসীন কট্টর ডানপন্থী সরকারকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

সবাই বলেছে, কিছু ঘনিষ্ঠ মিত্রের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ন্যাটোকে দুর্বল করেছে এবং বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বমঞ্চে একগুঁয়ে ও কট্টরপন্থী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, উদারপন্থী ও বামপন্থীদের এ অবস্থায় কী করা উচিত।

আমরা যারা বামপন্থা সমর্থন করি, তারা বরাবরই ট্রাম্প যা বলে এসেছেন বা করে এসেছেন, তার সবকিছুই প্রত্যাখ্যান করে এসেছি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার নীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তে আমরা না বিকল্প পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলছি, না বিদেশের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের বিরোধিতা করছি। আমরা জোর দিয়ে বলছি না, বহির্বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা স্বাতন্ত্র্যবাদ আসলে একটি দেশের কোনো পররাষ্ট্রনীতি না থাকারই নামান্তর।

এ অবস্থায় বামপন্থীদের প্রথমত এবং প্রধানত আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিতর্কের এটাই কেন্দ্রীয় ইস্যু। আমরা আমেরিকার বামপন্থীরা মনে করি, নিজেদের এবং মিত্রদের রক্ষায় শক্তি প্রয়োগ করা সঠিক হবে। অপরদিকে বিদেশে কট্টর কর্তৃত্ববাদী সরকারের পক্ষে কিংবা প্রবল জনসমর্থনপুষ্ট আন্দোলনের বিপক্ষে শক্তি প্রয়োগ করা ভুল হবে।

আমাদের বুঝতে হবে, ২০০৩ সালে ইরাকে অভিযান চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভুল কাজ করেছিল; কিন্তু আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দিয়ে এবং গণহত্যা থেকে ইয়াজিদিদের বাঁচানোর চেষ্টায় শামিল হয়ে তারা ঠিক কাজ করেছিল। আইএস অধিকৃত মসুলে হামলা চালানো ঠিক ছিল, কিন্তু পুরো শহরকে ধূলিসাৎ করাটা ভুল ছিল।

এ ছাড়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করার ডাক দেওয়াও ভুল ছিল, কারণ আসাদবিরোধী শক্তিগুলোর সমর্থনে প্রয়োজনীয় জনসমর্থন ছিল না এবং ওই জনসমর্থন অর্জনে তাদের সহায়তা করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুতও ছিল না। অন্যদিকে কুর্দিদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, কারণ নিজেদের লোকদের মধ্যে তাদের বিস্তর জনসমর্থন ছিল এবং আইএসের খেলাফতে হয়তো তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারত না।

আবার দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে সহায়তা দেওয়া ঠিক থাকলেও পরমাণু যুদ্ধের হুমকি-ধমকি দেওয়া নিশ্চিতভাবেই ভুল। কারণ, পরমাণু অস্ত্র মানবজাতির কোনো কল্যাণ আনতে পারে না। কিন্তু বামপন্থীদের এটাও অনুধাবন করতে হবে, যখন কোনো বিশেষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কিংবা মতাদর্শের মানুষ রাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বারা গণহত্যার শিকার হয়, তখন আমরা শান্ত হয়ে সেই দৃশ্য দেখব না।

আদি বামপন্থীরা মনে করেন, আমেরিকার মতো পুঁজিবাদী শক্তি বিশ্বের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। এটা ভুল ধারণা। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই আমেরিকাই বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর দুই শক্তি নাৎসি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটিয়েছিল।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

মাইকেল ওয়ালজার যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এর ইমেরিটাস অধ্যাপক