এখনো রোহিঙ্গারা আসছে

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তির আওতায় সরকার যখন কারিগরি কমিটি গঠন করছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখনো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ ও প্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে শুরু থেকে যে সংশয় ছিল, তা দিন দিন আরও বাড়ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশের ঘটনা প্রমাণ করছে যে সেখানে অত্যাচার-নির্যাতন এখনো থামেনি। আর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কোন মাত্রার বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে, তার নতুন এক প্রমাণ আমরা পেয়েছি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্রে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এক সমঝোতা স্মারকে সই হয় গত ২৩ নভেম্বর। এরপর আরও প্রায় ১০ হাজার শরণার্থী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চুক্তিটি যে মিয়ানমারের একটি কৌশল ছিল, সেটাও দিন দিন আরও পরিষ্কার হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে মিয়ানমারের ওপর বিশ্বজনমত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়ছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিয়ানমার সেই চাপ অনেকটাই কমাতে পেরেছে। ফলে এই চুক্তি মিয়ানমারের স্বার্থসিদ্ধি করলেও বাংলাদেশ এই চুক্তি থেকে আদৌ কোনো ফল পাবে কি না, সেই সংশয় প্রবল হচ্ছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী, তাদের পরিচয় যাচাই ও প্রত্যাবাসনের কাজ তদারকির জন্য চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ দুটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। মিয়ানমারের দেওয়া ফরম অনুযায়ী সরকার এই তালিকাভুক্তির কাজ করছে। পররাষ্ট্রসচিব তালিকা তৈরি ও প্রত্যাবাসনের অন্যান্য দিকের কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই তা-ই? গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ১০ রোহিঙ্গাকে নৃশংসভাবে হত্যা এবং এক কবরে তাদের পুঁতে ফেলার যে বিবরণ আমরা পাই, তাতে স্পষ্টতই সেখানে জাতিনিধনের প্রক্রিয়ার প্রমাণ মেলে। সেই পরিস্থিতি যে বদলে যায়নি, তার প্রমাণ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ অব্যাহত থাকা। সবচেয়ে বড় কথা, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের নীতির পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আস্থা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে এই শরণার্থীরা মিয়ানমারে ফিরে যাবে কোন ভরসায়।
মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপ বহন করা বাংলাদেশের জন্য যতই কষ্টসাধ্য হোক, এই পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে তাদের ফেরত পাঠানোর সুযোগ নেই। আর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে, সেখানেও স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে আগ্রহীদেরই ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলা আছে। এখন মিয়ানমার যদি ভীতির পরিস্থিতি বাজায় রাখে, তবে প্রত্যাবাসন সফল হবে কীভাবে? বিষয়টি অনেকটা এমন যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার চুক্তি করেছে, আবার রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনও জারি রেখেছে।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন সফল করতে হলে রাখাইন রাজ্যে এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে শরণার্থীরা সেখানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আস্থা পায়। আমরা বারবার বলে আসছি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ছাড়া মিয়ানমারকে এ ব্যাপারে বাধ্য করা যাবে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে সে ব্যাপারে অব্যাহত তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের ওপর যে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড হয়েছে, তার বিচার নিশ্চিত করতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাজে লাগাতে হবে।