রূপার জন্য ন্যায়বিচার, একটা দৃষ্টান্ত

আসামিদের আদালতে নেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইল, ১২ ফেব্রুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো
আসামিদের আদালতে নেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইল, ১২ ফেব্রুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো

আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন। বড় খুশির দিন। কারণ আজ রূপা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। যেসব নরপশুর হিংস্র নখরের আঘাতে রূপার দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, যারা রূপাকে চরম অবমাননার পর হত্যা করেছিল, তারা উপযুক্ত সাজা পেয়েছে। কিন্তু যে তরতাজা জীবনটা চলে গেল, যে পরিবার তাদের একটি আশা হারাল, তা কি আর ফিরে আসবে?

বলছি টাঙ্গাইলের চাঞ্চল্যকর রূপা খাতুন ধর্ষণ ও হত্যার মামলার রায়ের কথা। আজ টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকা প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবুল মনসুর মিয়ার আদালত রূপা হত্যা ও ধর্ষণ মামলার রায়ে চারজনকে ফাঁসির আদেশ এবং একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রূপা খাতুনকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে দেয় নরপশুদের ওই দলটি।

রূপা খাতুন সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের আসানবাড়ী গ্রামের মৃত জেলহক প্রামাণিকের মেয়ে। তিনি ঢাকা আইডিয়াল ল’ কলেজে পড়াশোনা করতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মা, তিন বোন, দুই ভাইয়ের সংসারে রূপাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছিলেন তিনি। ছোট বোন ও ভাইদের পড়ালেখার খরচও চালাতেন। লেখাপড়া শেষ করে আইনজীবী হবেন এমনটাই আশা ছিল রূপার। কিন্তু মানুষরূপী হায়েনারা তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। সেই হায়নারা আজ উপযুক্ত সাজা পেয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে? আমাদের মতো নিশ্চয়ই রূপার পরিবারও আজ অনেক খুশি। রূপার মায়ের সন্তান হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও হয়তো লাঘব হয়েছে। তাঁর মন কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেয়েছে।

কিন্তু যে সান্ত্বনা আজ রূপার মা পেয়েছেন। সেই সান্ত্বনা তো তনুর মা পাননি। পাননি রিশার মা বা রুনি ও সাগর সারোয়ারের মা। সান্ত্বনা পাননি আরও অনেকের মা।

প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, খুব দ্রুত রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ মামলায় অভিযোগ গঠন, সাক্ষী ও যুক্তিতর্কের জন্য মাত্র ১৪ দিন সময় নেওয়া হয়। অর্থাৎ অভিযোগ গঠন থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত এ মামলার পেছনে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৪ কর্মদিবস! গত ২৯ নভেম্বর এই মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরপর গত ৩ জানুয়ারি মামলার বাদী মধুপুরের অরণখোলা ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলামের সাক্ষীর মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব শুরু হয়। পরে আট কর্মদিবসে বিচারিক হাকিম, চিকিৎসক, তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে চার কর্মদিবসে আসামিদের পরীক্ষা এবং উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক হয়। অপরাধীদের শাস্তির পাশাপাশি, যে বাসের মধ্যে রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়, সেই বাসটি রূপার পরিবারকে দেয়ার আদেশ দিয়েছে। সত্যিই এটাও একটা দৃষ্টান্ত বটে।

আহা, সব ধর্ষণ ও হত্যা মামলার নিষ্পত্তি যদি এ রকম দ্রুতগতিতে হতো! কিন্তু সে রকম তো হয় না, হতে চায় না। কোথায় কোথায় যে বাধা পড়ে জানা যায় না। জানতে পারি না আমরা।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। দু বছর হতে চলল কিন্তু বিচার হওয়া তো দূর আজও তাঁর খুনিরা ধরাই পড়েনি। একই বছরের আগস্ট মাসে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বখাটের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। সেই বখাটে গ্রেপ্তার হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করেছেন। ব্যস এ পর্যন্তই। আর কোনো খবর নেই। ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা এখন পর্যন্ত হয়নি। যদিও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘোষণা করেছিলেন যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের ধরা হবে। কিন্তু সেই খুনিরা আজও ধরা পড়েনি। দীর্ঘ ছয় বছরে তদন্ত প্রক্রিয়ারও কোনো অগ্রগতি হয়নি। আবার অনেক হত্যা মামলার বিচার হলেও ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি।। যেমনটি পাননি বুশরার পরিবার। ২০০১ সালে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বাসায় খুন হন সিটি কলেজের ছাত্রী রুশদানিয়া বুশরা। এ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত চার আসামির মধ্যে তিনজনকে ২০০৩ সালে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে বাদী ও বিবাদী পক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ২০১৬ সালে মামলার সব আসামিকে খালাস দেন আদালত। একটি হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়ে গেল! এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে।

আমরা চাই রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার মতো সব মামলার বিচার এ রকম দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। অপরাধীরা যথোপযুক্ত সাজা পাবে। ন্যায় বিচারের এ রকম দৃষ্টান্ত আরও স্থাপিত হবে। এর বেশি কি কিছু আমরা চাই?

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক