খরচ বৃদ্ধি ও বিলম্বই রূপপুরের বাস্তবতা

যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁদের কাছে এটা পরিষ্কার যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বৈশ্বিক জ্বালানি ব্যবস্থাকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। স্মার্ট জ্বালানি নীতির অর্থ হলো দেশগুলো আর বৈদ্যুতিকীকরণ, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ইস্যুর মধ্যে একটি রেখে অন্যটি বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবে না। প্রযুক্তির অগ্রগতি আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির খরচ দ্রুত কমে আসায় কয়লাভিত্তিক ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। গত ১২টা মাস ছিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাতের জন্য বিপর্যয়কর। নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর খরচ বাড়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজে বিলম্ব সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এটা কী অর্থ বহন করে?

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থার বহুমুখীকরণ হিসেবে দেখছে, যার ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালে। বর্তমান বরাদ্দকৃত ১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বড় ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। দেশটি এই চুক্তিকে বৈশ্বিক বাজারে পারমাণবিক বিদ্যুতের চাহিদা হ্রাসের বিপরীতে নিজের পরমাণুশিল্প বাঁচিয়ে রাখার পথ হিসেবে দেখছে।

বৈশ্বিক বাজারের একটি চিত্রেই এই শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি ফুটে ওঠে। ফরাসি পারমাণবিক জ্বালানি কোম্পানি এআরইভিএ গত ছয় বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার লোকসান দেওয়ার পর এখন একপ্রকার দেউলিয়াই বলা চলে। এআরইভিএকে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত একটি কেলেঙ্কারির সঙ্গেও যুঝতে হচ্ছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার কারণে বেশ কয়েকটি পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ করে দিয়েছে ফ্রান্স। এসব লোকসানের কারণে ফরাসি সরকারকে ৫ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের জরুরি তহবিল সরবরাহ করতে হয়েছে।

এদিকে যুক্তরাজ্যের ইডিএফ এবং ফ্রান্সের এআরইভিএ ইউরোপে দুটো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছে। এর একটি হলো ফ্রান্সের ফ্লামঁভিল্লা, যার নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের চেয়েও সাত বছর পিছিয়ে গেছে এবং বাজেটের চেয়ে ৭০০ কোটি ইউরো বেশি খরচ হচ্ছে। অপর প্রকল্পটি ফিনল্যান্ডের ওলকিল্লোতোতে। এরও নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১০ বছর বিলম্ব হয়েছে এবং ব্যয় বাজেটের চেয়ে তিন গুণ বেশি হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের হিঙ্কলি পয়েন্টে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। ১৯৯৫ সালের পর এই প্রথম দেশটিতে এমন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হতে চলেছে এবং সম্ভবত কোনো দিনও তা কার্যক্রমে যাবে না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্মাণকাজের দায়িত্বে আছে ইডিএফ। তারা এরই মধ্যে স্বীকার করেছে, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এর নির্মাণকাজ ১৫ মাস পিছিয়ে পড়েছে এবং বাজেটের চেয়ে ২২০ কোটি পাউন্ড বেশি ব্যয় হতে চলেছে।

বৈশ্বিক পরমাণুশিল্প পরিস্থিতি-বিষয়ক ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে যে ৫৭টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, তার ৩৭ টিরই কাজ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিলম্বিত হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, গত দশকে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ শেষ হতে গড়ে সময় লেগেছে ১০ বছরের বেশি। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুরের নির্মাণকাজ শেষ করার নির্ধারিত সময়সীমাকে উচ্চাভিলাষীই বলা যায়।

অন্য যে দেশগুলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে, তারাও নির্মাণকাজের গতি ধীর করে এনেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি দেশ এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে: সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা দিয়েছে, দেশটিতে প্রশিক্ষিত ও নিবন্ধিত কর্মীর অভাবের কারণে তারা তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটির কাজ পিছিয়ে দিয়েছে। আর বেলারুশের অস্ত্রোভেৎস প্রকল্পে নির্মাণকাজের সময়ে চুল্লির চাপ প্রকোষ্ঠ পড়ে যাওয়ায় কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে।

সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বাংলাদেশ বৈশ্বিক ধারার উল্টো দিকেই যাত্রা করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন সরকার সম্প্রতি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসার ব্যাপারে আবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানিয়েছে, আর কোনো চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা তাদের নেই। এর আগে তাইওয়ান গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটি আইন প্রণয়ন করে, যাতে ২০২৫ সালের মধ্যে সেখানে পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যুগের সমাপ্তির কথা বলা হয়েছে। পরে একই পথে দক্ষিণ কোরিয়াও হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। এরও আগে অতিরিক্ত ব্যয় আর নিরাপত্তার কারণে ভিয়েতনাম দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ স্থগিত করে। ওই দুই কেন্দ্রও নির্মাণ করছিল রাশিয়ার রোসাটম (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান) এবং জাপানের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জোট।

বৈশ্বিক পরমাণুশিল্পের অবস্থা-বিষয়ক ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রবণতার কারণে বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে পারমাণবিক জ্বালানির উৎপাদনের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ১৯৯৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে তাকালেও দৃশ্যপটের খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না।

আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থার মহাপরিচালক আদনান জেড আমিন বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কেবল পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিই কাজ করে না, এটি অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার এই সম্ভাবনার বিষয়টি আমলে নিচ্ছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থা গড়তে কম কার্বন নিঃসরণকারী অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা আশা করছি, এই রূপান্তর ২০১৮ সাল এবং এর পরে আরও গতি পাবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে, প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, জাতীয় স্থিতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে ভূমিকা রাখবে।’

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা বহুমুখীকরণে একটি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এটি একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে। গ্রামীণ ব্যাংকের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ক্লিন এনার্জির প্রেসিডেন্ট দীপাল চন্দ্র বড়ুয়ার মতে, ২০১৭ সালে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচির পরিসর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এখানে প্রায় ৫০ লাখ এসএইচএস রয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ থেকে তিন কোটির বেশি মানুষ সরাসরি লাভবান হচ্ছে এবং এক লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ যদিও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তা সত্ত্বেও এখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুক অনুযায়ী, ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে ১০ লাখ ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হবে। এর তিন-চতুর্থাংশই বিনিয়োগ হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে। বাংলাদেশের সামনে এখন দুটো পথ খোলা: হয় এই পথে অগ্রসর হওয়া, নতুবা সেকেলে, ব্যয়বহুল, ধীর আর বিপজ্জনক প্রযুক্তির পথেই হাঁটা।

শেষ কথা হলো, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেয়ে অনেক কম সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ১০ বছর নয়, মাত্র ১৮ মাসেই উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য দূরীকরণ আর নিরাপত্তা নির্ভর করবে দ্রুত বর্ধমান এবং নির্ভরযোগ্য বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্কের ওপর। এই অগ্রগতি ধরে রাখতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই এখন সবচেয়ে ভালো উপায় এবং বিশ্বজুড়ে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। পক্ষান্তরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগত কমছে-এর চেয়ে পরিষ্কার চিত্র আর কিছুই হতে পারে না।

অনুবাদ: রাজিউল হাসান

সাইমন নিকোলাস: জ্বালানি অর্থনীতি বিশ্লেষক, ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিসিস