রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলা

টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী রূপা খাতুনকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার মাত্র ১৪ কর্মদিবসে সম্পন্ন করা একটি বিরল ঘটনা। উপরন্তু এই মামলার ৭৩ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক আবুল মনসুর মিয়া নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে যে আটটি নির্দেশনা দিয়েছেন, সরকার, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমিতি, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের উচিত হবে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া।

পাঁচ আসামির মধ্যে চারজনেরই ফাঁসি হওয়ার পাশাপাশি এই রায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে এই কারণে যে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত বাসটির মালিকানা রূপার পরিবারকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের এই সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অভিনব মনে হতে পারে। আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলো সাধারণত এই এখতিয়ার অনুসরণ করেন না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫ ধারার আওতায় বিচারিক আদালতের ভুক্তভোগী পরিবারকে এ ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদানের এখতিয়ার রয়েছে, কিন্তু এর তেমন প্রয়োগ নেই। ওই বিধি বলেছে, অপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো দেওয়ানি আদালত থেকে যে ধরনের ক্ষতিপূরণ উশুল করতে পারেন, তা বিবেচনায় বিচারিক আদালত রায় ঘোষণার সময় জব্দ করা সম্পদ থেকেই ক্ষতিপূরণ মেটাতে পারেন।

ট্রাইব্যুনালে এই মামলার দ্রুত বিচার যেভাবে শেষ হয়েছে, আমরা হাইকোর্ট বিভাগের কাছ থেকেও দ্রুততার সঙ্গে আপিল আবেদন নিষ্পত্তি আশা করি। আর রায়ের আট দফা নির্দেশনার সফল বাস্তবায়ন অনেকাংশে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। বিচারকের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমরা একমত যে ‘গাড়ির স্টাফদের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ মালিক সমিতি-ইউনিয়ন নিলে অবশ্যই তাদের স্টাফদের এসব ঘৃণ্য অপরাধের দায়ও নিতে হবে। তবে মালিক-ইউনিয়নের দায় হবে শুধুই আর্থিক।’ তবে ‘দায়’ নির্ধারণের এই দৃষ্টিভঙ্গির নৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারকে উদ্যমী ভূমিকা গ্রহণ ও প্রয়োজনে প্রচলিত আইনে পরিবর্তন আনতে হবে।

আদালত যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে মালিকপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নকে এ রকম দায়িত্বশীলতার মধ্যে আনলে তারা অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং স্টাফদের অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়াটাকে শ্রেয় মনে করবে। আদালতের রায় পড়ে প্রতীয়মান হয় যে বিচারক সন্দেহ করেছেন, অপরাধীরা মাদকাসক্ত ছিলেন। সে কারণে বিচারক বছরে অন্তত চারবার পরিবহনকর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং কোনো ধরনের মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চাকরিতে না রাখার বিষয় নিশ্চিত করতে হুঁশিয়ার করেছেন।

আদালতের এই উপলব্ধিও তাৎপর্যপূর্ণ যে ‘সর্বোচ্চ শাস্তি সাধারণত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবেই গণ্য হয়, কিন্তু শুধু সেই শাস্তি দিলেই কোনো অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়।’ নারী নির্যাতন দমন আইনে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড চালু করার পরেও আমরা আমাদের সমাজে নারীর প্রতি মর্যাদা বৃদ্ধি কিংবা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। এক দশক আগেও যেখানে বছরে ১০ হাজারের কিছু বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

রূপা হত্যা মামলায় পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে। এরপর তাঁরা কেউ জামিনে বেরিয়ে যেতে পারেননি, সেটাও হয়তো বিচারকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছে। পুলিশ, স্বাস্থ্য প্রশাসন, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় আলোচ্য মামলাটি দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়েছে। আমরা তাঁদের সাধুবাদ জানাই। গণমাধ্যম বিবেচনায় নেবে যে বিচারক তাঁর রায়ে একটি আক্ষেপ করেছেন। বলেছেন, অপরাধের খবর যত ব্যাপকতায় প্রচারিত হয়, বিচারকার্য তা হয় না!