বিএনপি ভাঙলে আওয়ামী লীগের কী লাভ?

শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হওয়ার পর রাজনীতির দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা নতুন করে ভোটের হিসাব–নিকাশ করা শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, দুর্নীতির দায়ে বিএনপি নেত্রী দণ্ডিত হয়েছেন। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমানও একাধিক মামলায় দণ্ডিত। ফলে ভোটের রাজনীতিতে এর সুফল আওয়ামী লীগ পাবে। অন্যদিকে, বিএনপি নেতাদের দাবি, এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এ কারণে খালেদা জিয়া জনগণের সহানুভূতি পাবেন। নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়বে।

একই সময়ে নদীতে যেমন জোয়ার ও ভাটা হয় না, তেমনি একই সঙ্গে দুই পক্ষের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এক দলের পাল্লা ভারী হলে আরেক দলের পাল্লায় টান পড়বে। এটাই নিয়ম।

এই মুহূর্তে সরকার স্বস্তিবোধ করতে পারে এ কথা ভেবে যে খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরও বড় কোনো আন্দোলন হয়নি। রাজপথ মোটামুটি শান্ত আছে। বিএনপি গরম কোনো কর্মসূচি না নিয়ে ঝটিকা মিছিল, মানববন্ধন ও অনশনের মধ্যে তাদের কর্মসূচি সীমিত রেখেছে। দলের ২০১৩-১৪–এর আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করলে এসব একেবারে নিরীহ কর্মসূচি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে যেতে চায় বলেই এখন রাজপথ উত্তপ্ত করা সমীচীন মনে করছে না। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও কারাগারে যাওয়ার আগে নেতা-কর্মীদের সে রকম বার্তা দিয়ে গেছেন।

এরই মধ্যে বিএনপির ভাঙার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতা ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপি ভাঙা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে তিনি এও বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিএনপি ভাঙবে না। বিএনপির দলের নেতা-কর্মীরাই তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা দিয়ে দল থেকে বেরিয়ে আসবেন। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন তিনি চান না, বিএনপি ভাঙুক।

বিএনপির ভাঙন বলতে কী বোঝায়? কয়েকজন নেতার চলে যাওয়া? এর আগেও বহুবার বিএনপি থেকে নেতারা দলে গেছেন। তাতে বিএনপির ক্ষতি হয়নি। গত নয় বছরে বিএনপির ওপর অনেক ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় তো বটেই উপজেলা পর্যায়ের কোনো নেতাও বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে হিজরত করেননি। ভবিষ্যতে করবেন কি না সময়ই বলে দেবে।

দ্বিতীয়ত, বিএনপি ভাঙলে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কী লাভ? বিএনপি–সমর্থকদের ভোট কি তারা পাবে? একসময় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বর্তমানে বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী অঙ্ক কষে দেখাতেন, কারা বিএনপিকে আর কারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন? তাঁর মতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী, বামধারা ও সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটার। আর বাংলাদেশি জাতীয়বাদী, ইসলামি শক্তি বিএনপির ভোটার।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে এখন সেই বিভক্তি টানার সুযোগ কম। বাম শক্তি অতিশয় দুর্বল। এরশাদ নিজেকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করেন। ইসলামি শক্তির অনুসারীদের ভোট পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই ধরনা দিচ্ছে। বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছে, আর আওয়ামী লীগ হেফাজতকে নিজের দিকে টানছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ভাঙলে আওয়ামী লীগের খুব লাভ হবে না। বরং মানুষ বিএনপি ভাঙার জন্য সরকারকেই দোষারোপ করবে।

আরেকটি কথা মনে রাখা দরকার, দল ভাঙলে নেতারা ভাগ হয়ে যান। ভোটের ওপর এর তেমন প্রভাব পড়ে না। এরশাদ বিএনপির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে বিএনপির ভোট কমেনি। বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপি ঘরানার নামে নানা দল ও জোট হলেও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এক ভদ্রলোক তো ‘আসল বিএনপি’ নাম দিয়ে পুলিশ প্রহরায় মিছিল করতে গিয়ে খালেদার নেতৃত্বাধীন বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া খেয়ে লা পাত্তা হয়ে গিয়েছেন।

বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সরকারের সমর্থনে নতুন ব্যানার নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এখন তিনি ঢাকার গুলশান-বনানী থেকে নির্বাচন করার খায়েশ প্রকাশ করেছেন। এই আসনের বর্তমান সাংসদ বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। ২০০৮–এর সংসদে ছিলেন এরশাদ। এঁরাও ফের প্রার্থী হতে আগ্রহী। অর্থাৎ বিএনপি ঘরানা থেকে যত নেতা আওয়ামী জোটে আসবেন, প্রার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। কিন্তু ভোটার বাড়বে বলে মনে হয় না।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় জেল হলেও উচ্চ আদালতের জামিন নিয়ে খালেদা জিয়ার অনায়াসে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, অত সহজ হবে না। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৩৪। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনই কারাগারে থাকলেও তখন কারও মামলার সুরাহা হয়নি। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় বাতিল হলেও খালেদা জিয়ার মামলা চলছে। এ নিয়েও মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কি একই ফল হতো?

মামলা আইন–আদালতের বিষয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলার উত্তাপ রাজনীতিতে এসে পড়েছে। আগামী নির্বাচন তক এই উত্তাপ থাকবে। এই মুহূর্তে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। দলের প্রধান জেলে। দ্বিতীয় প্রধান নির্বাসিত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দৃশ্যত অনেক বেশি ক্ষমতাবান। দলের সাংগঠনিক শক্তিও মজবুত। কিন্তু অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্বাচনী লড়াইয়ে জিততে হলে শুধু দলীয় সমর্থকদের ভোট যথেষ্ট নয়। নির্বাচনে জিততে হলে আওয়ামী লীগকে যেমন দলের বাইরের ভোট পেতে হবে। ২০০১ ও ২০০৮–এর নির্বাচনই তার প্রমাণ।

আওয়ামী লীগ–সমর্থক একজন শিক্ষাবিদ বলেছেন, খালেদার মামলা আগামী নির্বাচনে বড় ইস্যু হবে। দুই পক্ষই চাইবে মামলার কথা বলে ভোটারদের সমর্থন বাড়াতে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দেশের ভেতরে ও বাইরে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়নি বলে আওয়ামী লীগ অনেকটা নির্ভার আছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া হয়, সেটি বলা কঠিন।

১৯৯১ সালে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা আরও নড়বড়ে ছিল। দলের বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাকে এরশাদ ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী ছিল। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফল বিএনপির পক্ষে যায়। এরপর প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি ঘটেছে। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচন এই সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না। কেননা, সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার দলীয় প্রার্থী জয়ী হন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। দেশবাসীও চায় না আগামী নির্বাচন যেন ২০১৪–এর পুনরাবৃত্তি হোক।