সুপ্রিম কোর্টকেই নেতৃত্ব দিতে হবে

সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে নতুন বিচারক নিয়োগে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হকের দীর্ঘদিনের আশ্বাস শিগগির বাস্তবায়িত হতে চলেছে। কিন্তু ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ১০ বিচারকের মামলায় দেওয়া আপিল বিভাগের দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে আসন্ন নিয়োগপর্ব সম্পন্ন হবে, তেমন কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত আমরা লক্ষ করছি না।

এখানে ভারতের বিচার বিভাগের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত প্রতিটি শুনানি ও রায় মূলত ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ওপর দাঁড়ানো। বিচারক নিয়োগে সেখানে বিচারকদের তৈরি করা আইনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কলিজিয়াম ব্যবস্থা কার্যকর হলেও তা ‘গোপনীয়তার বৃত্তে বন্দী’ বলে নাগরিক সমাজ দ্বারা সমালোচিত হচ্ছিল। সমালোচনার মুখে তারা সেই বৃত্ত সম্প্রতি ভেঙেছে। আমাদেরও সেই পথে যেতে হবে। এক হাজার বছরের বৃত্ত ভেঙে ব্রিটেন জুডিশিয়াল কমিশন করার পরেই এই কলামে আমরা বলেছিলাম, বিচারক নিয়োগে ভারতীয় গোপনীয়তার দিন ফুরিয়ে আসছে, গত বছরের অক্টোবরে সেটাই ঘটেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের কলিজিয়ামের যে চারজন সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জাতিকে সরাসরি (আইনমন্ত্রী ব্রিফিং করেননি) জানিয়েছেন, হাইকোর্টের বিচারপতি বা প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সুপারিশ তাঁরা কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন, তা এখন থেকে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কলিজিয়াম তার ৩০টি সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে। এটা কিন্তু ভারতের মতো দেশে এই সেদিনও অকল্পনীয় ছিল।

নতুন বিচারপতি নিয়োগ লগ্নে আমরা তাই আমাদের একটি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে চাই। সেটা হলো নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তাঁর অভিষেকের অনুষ্ঠানে বলেছেন, সংবিধানের ৯৫ (২ গ) অনুচ্ছেদের আওতায় বিচারক নিয়োগে একটি আইন করা দরকার। আমরা তাঁর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলব, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ যেন আর বিলম্ব না করে। যদি আমরা ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ফরমান বলে সংবিধানে তা যুক্ত হওয়ার ইতিহাস মনে না রাখার সংকল্প করি, তাহলেও মনে পড়বে, আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে সেটি নতুন করে যুক্ত করার পরেও সাতটি বছর চলে গেছে। এবারেও, প্রধান বিচারপতির আইন করার অনুরোধের উত্তরে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সরকার বা সংসদের পক্ষে জাতিকে এখন পর্যন্ত কেউ আশ্বস্ত করেনি।

যে কথার ওপর আমরা জোর দিতে চাই সেটা হলো, সুপ্রিম কোর্টের রায় বা তাঁর তৈরি করা আইন যেখানে কার্যকর হয় না, সেখানে একই বিষয়ে শুধু সংসদ আইন করে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে, তা ভাবতে আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রবল। বিচারকের তৈরি করা ‘আইন’ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তৈরি করা ‘আইন’-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সংবিধানের চোখে দুটোই অবশ্যপালনীয় আইন। বরং আমরা যদি আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় নিই, তাহলে বিচারক নিয়োগে নিজের তৈরি করা আইন নিজেরা মেনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পথে না হাঁটার বিকল্প দেখি না। ওই রায়ের মূল লেখক বিচারপতি এম এ মতিন আমাদের বলেছেন, তিনি বেশ পীড়া অনুভব করেন এটা দেখে যে আপিল বিভাগের একটি সর্বসম্মত রায়, যেখানে বিচারক বাছাইয়ের প্রতিটি ধাপের লিখিত নথি সংরক্ষণ অপরিহার্য করা হয়েছে, সেখানে সেই ‘আইন’ অকার্যকর রয়েছে। অথচ নতুন করে আইন করার কথা উঠছে।

ওই রায়ের পরে বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে আমরা পাঁচজন প্রধান বিচারপতি পেয়েছি, চারজনের আমলে (২০১০-১৫) নিয়োগ পাওয়া প্রায় ৫০ জন বিচারক হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে কর্মরত। কিন্তু দুঃখজনক হলো নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় ১০ বিচারকের মামলার দিকনির্দেশনার ছাপ আদৌ পড়েছে কি না, তা বাইরে থেকে অস্পষ্টভাবেও বোঝা যায় না। অথচ ওই দিকনির্দেশনায় স্পষ্ট বলা আছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি কাকে কী কারণে বাছাই করছেন, কে বাদ পড়ছেন, সে বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। জানতে চাইলে বিচারপতি এম এ মতিন পরিষ্কারভাবে আশ্বস্ত করেছেন যে, কী কারণে কে যাচ্ছেন আর কে বাদ পড়ছেন, তাঁর রেকর্ড নাগরিক বা সাংবাদিকেরা চাইলে সুপ্রিম কোর্টের তা প্রকাশে আমি কোনো বাধা দেখি না।

যখনই স্বচ্ছতা বা গোপনতা ভঙ্গের প্রসঙ্গ তোলা হয়, তখন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের ২ দফার গ উপদফা অনুযায়ী আইনটি হয় না বলেই স্বচ্ছতায় ঘাটতি চলছে। প্রধান বিচারপতির অভিষেকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিচ্ছিন্নভাবে একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে নির্দিষ্ট করে বলেছেন, তাঁর ইংরেজি জ্ঞান এতটা দুর্বল যে লোকে তা নিয়ে ‘হাসাহাসি’ করতেন। ওই বিচারক বিএনপির আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তিনি এতটা অকপট হতে পেরেছেন। বিএনপির গত আমলের শেষ দিকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অযোগ্য বা আধা দক্ষ লোককে বিচারক নিয়োগ দেওয়ার প্রতিবাদে প্রস্তাব পাস করিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। কিন্তু তার প্রতিকার হয়নি। আবার এই আমলে কেরানি হতেও অযোগ্য এমন লোক যে বিচারক হয়েছেন, তা খোদ আওয়ামী লীগের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছিলেন।

এখন আবারও আমরা বিস্ময়কর ধারণা পাচ্ছি যে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ-প্রক্রিয়া কী হবে এবং কখন কী কারণে কতজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তার সবটাই ‘রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার’-এর বিষয়। যেন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার’ আপনাআপনি একটি স্বচ্ছ বিষয়!

১৯৯৪ সালে বিএনপি প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতিকে একেবারে উপেক্ষা করে বিচারক নিয়োগের উদ্যোগ নিলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আইনমন্ত্রী হিসেবে মওদুদ আহমদ যুক্তি দিয়েছিলেন, চতুর্থ সংশোধনীতে বিচারপতি নিয়োগে ‘প্রধান বিচারপতির পরামর্শ’ তুলে দেওয়া হয়েছে। বিতর্কের মুখে ১৯৯৪ সালে বিএনপি পিছু হটলেও তারা যেন এর শোধ তুলেছিল ২০০৩ সালে। অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে একত্রে নিয়োগ পাওয়া নয়জন অতিরিক্ত বিচারকের মধ্যে মাত্র দুজনকে (বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. ইমান আলী) স্থায়ী করেছিল বিএনপি।

অ্যাটর্নি জেনারেল ১০ বিচারকের মামলায় বলেছিলেন, প্রধান বিচারপতির পরামর্শে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দেবেন, কারণ প্রধান বিচারপতির পরামর্শ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলেও প্রধান বিচারপতির পরামর্শ অগ্রাহ্য করার অভিযোগে স্থায়ী হতে না পারা অন্তত দুজন সংক্ষুব্ধ বিচারপতি রিট করেছেন। কিন্তু এবারে আর অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতির ‘পরামর্শে’ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেখেননি। আবার প্রধান বিচারপতি কোন বিবেচনায় কী ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন, আদৌ দিয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে জাতি অন্ধকারে।

এসবই নির্দেশ করে যে নেতৃত্বটা প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টকেই দিতে হবে। ভারতের কলিজিয়াম বহু বছর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা তাদের সুপারিশ প্রকাশ করবে। কিন্তু তারা বাস্তবে তা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু বিচারক নিয়োগে সংবিধানের ৯৯ তম সংশোধনী (ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কমিশন গঠন) বাতিল করে তারা সরকারকেই বদলাতে বলেনি, নিজেদেরও বদলে নিয়েছে। আমরা একই অনুশীলন ও উপলব্ধি আশা করি। নতুন বিচারক নিয়োগে সাময়িক অচলাবস্থা কাটিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্ট এখন কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন, সে বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট (supremecourtofindia.nic.in/collegium-resolutions) ও আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে (doj. gov. in/appointment-of-judges) রাখা নথিগুলো আমাদের পথ দেখাতে পারে। দশ বিচারকের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, প্রার্থীর আইনি তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি দেখবেন প্রধান বিচারপতি, পূর্ব বৃত্তান্তের খোঁজ দেবেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তার কার্যপ্রণালি গত আট বছরেও লেখা হয়নি। ওই দুটি ওয়েবসাইটে রাখা নথিগুলো সেই শূন্যতা পূরণে সহায়ক হতে পারে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]