ডিজিটাল যুগের অ্যানালগ মানস

গতকাল প্রথম আলোয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছে। তিনি বলেছেন, যুগটা ডিজিটাল, কিন্তু পরীক্ষাপদ্ধতি অ্যানালগ, পূর্বতন পদ্ধতি দিয়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যাবে না। উন্নত দেশগুলোতে এ ব্যাপারে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তা আমাদেরও করতে হবে।

স্যারের সঙ্গে আমি শুধু সুর মেলাব না, ব্যাপারটাকে আরেকটু বড় প্রেক্ষাপটে নেব। আমাদের মানসিকতা ও নৈতিকতাবোধ অ্যানালগ, কিন্তু আমরা ঢুকে গেছি ডিজিটাল যুগে। বহু সমস্যার মূলে আছে যুগ আর মনের এই ব্যবধান।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদই বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটা মূল ব্যাপার পরীক্ষা; আর পরীক্ষার মূল ব্যাপার প্রশ্নপত্র। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষার কোনো মূল্য থাকে না, আর পরীক্ষা অর্থহীন হয়ে পড়লে শিক্ষাব্যবস্থাই ধসে পড়ে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে ধসে গেছে। পরীক্ষা ব্যাপারটা চালু হয়েছিল শিক্ষার্থী কেমন শিখল, কেমন দক্ষতা আর যোগ্যতা অর্জন করল, তা মূল্যায়নের জন্য। মূল্যায়নের রিপোর্ট সারা জীবন তার কাজে লাগবে। কিন্তু এখন ওই রিপোর্টই ভুল আসছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে কে প্রকৃত শিখেছে আর কে শেখেনি, তা নির্ণয় করা যায় না। সমস্যা শুধু এটা নয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র যে শিক্ষার্থী পাচ্ছে আর হলে যাচ্ছে, তার নৈতিকতার মানটা কোথায় যাচ্ছে ভাবুন। ভাবুন, যেসব শিক্ষক, কোচিং সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর অভিভাবক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের নৈতিকতা কোন স্তরে নেমে যাচ্ছে! এঁদের দিয়ে আমরা উন্নত নৈতিকতার সমাজ গড়ে তুলব কী করে? এখানেই আমি বলছি, আমাদের হাতে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, কিন্তু আমাদের নীতি-নৈতিকতা, আমাদের মন-মানসিকতা পড়ে আছে অন্ধকার যুগে। আমরা এখনো ভাবি, লেখাপড়া করতে হয় জুড়িগাড়ি চড়ার জন্য, চাকরি পাওয়ার জন্য। তোকে শিখতে হবে না, তুই রেজাল্ট ভালো এনে দে, তোকে এমন জায়গায় ভর্তি করাব, যাতে তোর পেশাটা ভালো হয়, তুই টাকাকড়ি কামাতে পারিস।

আমি বলব, আমাদের মনে শিক্ষা নিয়ে একটা অ্যানালগ ধারণা আছে। তারপরও যে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ছে না, এর কারণ পরীক্ষার ফল দিয়ে আসলে কিছুই হয় না। সারা বছর অনেক শিক্ষার্থীই পড়াশোনা করে, পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র পাওয়া যাবে, এই আশায় তারা বসে থাকে না। তা না হলে তারা এত কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে কেন? স্কুলের ক্লাস থেকে বেরিয়ে এই কোচিং সেন্টার থেকে ওই কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে দৌড়াতে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আসল উদ্দেশ্য যেখানে শিক্ষা নয়, ফল; সেখানে তা-ই হওয়ার কথা।

বহুদিন আগে, আবুল মনসুর আহমদ পরীক্ষা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রিত্বের অধীনে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। তিনি শিক্ষাবিদদের ডেকে বলেছিলেন, ‘পরীক্ষার উদ্দেশ্য তো আসলে এই যে আমরা বছর দীঘালি ছাত্রদেরে যা পড়াইলাম, তা তারা পড়িয়াছে বুঝিয়াছে কি না তারই টেস্ট করা। তার বদলে আমরা যদি ছাত্রদেরে না পড়াইয়াই, শুধু কতকগুলো পুস্তক পাঠ্য তালিকাভুক্ত করিয়াই, সেই সব পুস্তক হইতে, অনেক সময় সেই সব পুস্তকের বাহির হইতেও, প্রশ্ন করিয়া ছাত্রদের বিদ্যা পরখ করিতে চাই, তবে সেটা পরীক্ষা হয় না, হয় অবিচার।’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)

বলছিলাম, পরীক্ষা ধসে পড়লে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ধসে পড়ে। তবে আশার কথা হলো, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জগতে খুব বেশিজনের খুব বেশি কাজে লাগে না। কিন্তু যাদের লাগে, তারা যদি না শেখে, তাহলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। ডাক্তার যদি রোগ নির্ণয় করার মতো যোগ্যতা না রাখেন, প্রকৌশলী যদি ভুল নকশার ভবন বা যন্ত্র বানান, তাহলে সর্বনাশ।

আমরা একটা সর্বনাশের চক্করে পড়েছি। দাবানলের মতো প্রশ্নপত্র ফাঁস আর নৈতিকতার ধসের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে আমার শিক্ষক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর পরামর্শ আমি কয়েক বছর ধরে প্রচার করছি। তিনি বলেছিলেন, প্রতিটি বিষয়ে অনেকগুলো সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করে (ধরা যাক, দশ সেট) বছরের শুরুতেই প্রকাশ করে দেওয়া হবে। এই প্রশ্নগুলো পরীক্ষার হলে সব সময়ই প্রস্তুতও থাকবে। পরীক্ষার দিন সকালে শুধু জানিয়ে দেওয়া হবে, প্রশ্ন হবে অমুক সেটে। সেটা করা হবে একেবারে শেষ মুহূর্তে। শুধু নকল করা ঠেকানো গেলে এতে অন্তত বৈষম্য থাকবে না, কেউ পাবে কেউ পাবে না, তা হতে পারবে না, আর নৈতিকতার মহামারি রোধ করা যাবে। আর দশ সেট প্রশ্নপত্রের উত্তর যারা শিখে ফেলবে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানটা খারাপ হবে বলে মনে হয় না। এরপর জোর দিতে হবে সংস্কৃতিচর্চা-বিতর্ক, বক্তৃতা, আবৃত্তি, সংগীত, শিল্প, নাটক, বিজ্ঞান ক্লাব, গণিত ক্লাব, প্রকৃতিচর্চা, খেলাধুলা, সংগঠন, সমাজসেবা, নৈতিকতা ইত্যাদির ওপরে।

এই পরামর্শ-একাধিক সেটের প্রশ্নপত্র তৈরি রাখা-কেন কেউ শুনল না, জানি না। আমাদের সময়েও তো তিন সেট প্রশ্ন তৈরি করে রাখা হতো। যাক, এখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পরামর্শ শুনুন, উন্নত বিশ্বের পদ্ধতি থেকে শিক্ষা নিন।

তবে সব জায়গাতেই যে হতাশারই কেবল ছবি, তা হয়তো নয়। আমরা গণিত অলিম্পিয়াড বা ভাষা প্রতিযোগে যখন যাই, তখন এমন সব বিস্ময়কর প্রতিভার দেখা পাই যে বড় আশায় বুকটা ফুলে উঠতে চায়।

আমাদের শিক্ষার মানের অবনমনের চিহ্ন এসে পড়েছে বইমেলায়ও। গত বছর বাংলা একাডেমির এক আলোচনায় এ কথা বলা হয়েছিল যে মানসম্পন্ন বই মাত্র ১০ শতাংশ। আমি বলি, যদি ১০ শতাংশ মানসম্পন্ন বই এসে থাকে, তাহলেও এ বছর ৩০০ থেকে ৪০০ মানসম্পন্ন বই বেরোবে। গত ২০ বছরে অন্তত দুই হাজার মানসম্পন্ন বই বেরিয়েছে এ দেশে। কটা কিনেছি? কটা পড়েছি?

আমি বইমেলার বিভিন্ন প্রকাশনীর পুস্তক তালিকা হাতে নিয়ে দেখি, কেনার মতো এত বই আছে যে বই নিয়ে ফিরতে হলে ঠেলাগাড়ি লাগবে। অন্য সবকিছু বাদও যদি দিই, প্রথমায় বিচিত্র ধরনের বই আছে, সবই সুসম্পাদিত; বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বাছাই করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ করে রাখা হয়েছে, প্রতীক বা অবসরের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, বিভূতি, ওয়ালীউল্লাহ, মীর মশাররফ হোসেনের প্রকাশনার মান অনিন্দ্য, এমনকি কেউ যদি সেবা প্রকাশনীতে গিয়ে কিশোর ক্ল্যাসিকগুলো কেনে, তার ঘর আলোকিত হয়ে উঠবে।

তারপরও বারবার করে বলব, আমাদের প্রকাশকদের উচিত পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, তাতে সম্পাদক থাকবেন, সংশোধক থাকবেন। কবিতা-গল্পের শিল্পমান একটা তর্কসাপেক্ষ জিনিস, কিন্তু কোনো বই-ই মুদ্রণপ্রমাদ কণ্টকিত হতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথের লেখাকেও সমালোচকেরা অতি নিন্দা করেছিলেন, জীবনানন্দ দাশকেও কবি মনে করা হতো না, কাজেই সাহিত্যের মান বিচার তর্কাতীত থাকবে না; কিন্তু ভুল বানানের বই, ভুল বাক্যের বই যেন না বেরোয়, সে জন্য প্রকাশকদের অবশ্যই সম্পাদক রাখতে হবে। রাখব যে পাবটা কই? শিক্ষার মানে ধস নামলে ভালো বাংলা জানা, ভালো ইংরেজি জানা, ভালো ইতিহাস জানা, ভালো দেশ-বিদেশের খবর রাখা মানুষ আসবে কোত্থেকে?

আসবে। যদি বাংলাদেশের মানুষের মনটা আধুনিক হয়। তারা যেদিন মনে করবে, পরীক্ষার ফল নয়, শিক্ষার মানে হলো ভালো মনের দক্ষ মানুষ তৈরি করা, মানুষের মতো মানুষ তৈরি করা, সেদিন বাংলাদেশ হবে সুন্দর একটা দেশ।

মানুষের মনটা এগিয়ে নেওয়ার জন্যও দরকার জাদুকরি আদর্শবাদী নেতৃত্ব।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, সাহিত্যিক