যে কারণে জুমাকে কেউ মনে রাখবে না

জ্যাকব জুমা
জ্যাকব জুমা

২০০৯ সালের মার্চে, অর্থাৎ বর্ণবাদ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হিসেবে জ্যাকব জুমার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই মাসের কম সময় আগে দালাই লামা দক্ষিণ আফ্রিকার ভিসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টুটু এবং এফ ডব্লিউ দ্য ক্লার্কের আমন্ত্রণে জোহানেসবার্গে একটি শান্তি সম্মেলনে তিব্বতের এই আধ্যাত্মিক নেতার যোগ দেওয়ার কথা ছিল। দালাই লামাকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢুকতে না দেওয়ার এই সরকারি সিদ্ধান্তকে তখন চীন সরকারের কাছে মাথা নত করার নামান্তর বলে সমালোচনা করা হয়েছিল। এমনকি তখন টুটু এ ঘটনাকে ‘জাতির সুদীর্ঘ সংগ্রামের সঙ্গে নির্জলা বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

এ ঘটনাকে দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বগ্রাসী অন্ধকার আগমনের অন্যতম লক্ষণ বলা চলে। বর্ণবাদ যুগ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট থাবো এমবেকি যদি ম্যান্ডেলার ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) মূল্যবোধগুলোকে কূটরাজনীতি আর স্বার্থের বেদিতে বলি দিয়ে থাকেন, তাহলে জুমা তাঁর চেয়ে অনেক অনেক বেশি খারাপ কাজ করেছেন।

পরবর্তী নয় বছরের পুরোটা সময় প্রেসিডেন্ট জুমা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করতেন বলে অভিযোগ আছে। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীকে ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদ পাহারার কাজে ব্যবহার করেছেন। সবকিছু হাতের মুঠোয় রাখতে তিনি বিমান সংস্থা, বিদ্যুৎ সংস্থা, জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্রসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদে নিজের অনুগত ক্যাডারদের বসিয়েছেন। অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে কেউ এসব অনিয়ম নিয়ে মামলা করেনি। মৌখিক যত অভিযোগ উঠেছে, তার সবই তিনি অস্বীকার করে এসেছেন।

জুমার বিরুদ্ধে এএনসির মূল্যবোধে আঘাত করার অভিযোগ ওঠে ২০০৫ সাল থেকে। ওই বছর ডেপুটি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তির বিষয়ে ঘুষ নেওয়া এবং এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়েকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে। মামলা হয়। ২০০৯ সালে সব অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেও গ্রিক পুরাণের ডেমোক্লিসের তরবারির মতো নতুন নতুন অভিযোগ গদিতে থাকার পুরোটা সময়ে তাঁর মাথার ওপর চক্কর দিতে থাকে। গত বছর আপিল আদালত তাঁর স্থগিত হয়ে থাকা ৭৮৩টি মামলার সব কটি সচল করার আদেশ দেন। যদিও জুমা বরাবরই সব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। যে নারী তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিলেন, তিনি ২০১৬ সালে বিচার না পেয়েই মারা গেছেন।

এখন কথা হলো, দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর ব্যর্থতা কোথায় ছিল? এত দিন ধরে পচাগান্ধা পানিতে সবাইকে চুবিয়ে রাখার সুযোগ একজন লোককে তারা কেন দিল?

এর জবাব একটা নয়, অনেক। সেই জবাবগুলো এক জায়গায় জড়ো করলে বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার এ রকমের একজন প্রেসিডেন্টই প্রাপ্য ছিল। নব্বইয়ের দশকে সব জাতির ঐক্যের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীকে ‘রেইনবো নেশন’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর দেখা গেল, সমাজের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লোকগুলো আগের মতো গণ্ডিবদ্ধ এবং সুবিধাবঞ্চিত লোকেরা আগের মতোই ক্ষুব্ধ রয়ে গেছে। আর সম্মিলিতভাবে জাতি বিগত সাড়ে তিন শ বছরের বর্ণবৈষম্যের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। জনতুষ্টিবাদী লোকের দ্রুত প্রবেশ এবং সবকিছু নষ্ট করে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম ক্ষেত্র আর কী হতে পারে?

এমবেকি দেশের সব সমস্যা বড় বড় বুলি আর তাঁর পাইপ খাওয়ার অনন্য ভঙ্গিমা দিয়ে মোকাবিলা করতেন। তাঁর তুলনায় জুমা বেশি আমুদে ও জনঘনিষ্ঠ মানুষ। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এএনসির ন্যাশনাল পলিসি কনফারেন্স জুমাকে দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করার পর তিনি জনগণের সঙ্গে নেচে-গেয়ে উদ্বিগ্ন জাতিকে শান্ত করলেন। জনগণকে আমোদ-আহ্লাদের মধ্যে ভুলিয়ে রাখার কূটকৌশল তিনি ভালোই জানেন এবং এটিই তাঁকে টিকিয়ে রেখেছিল।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ দিনগুলোতেও জুমা টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করেছেন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিলেন। একটা কিছু ঘটতে পারে সেই আশায় ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা ছাড়ার বিদায়ী ভাষণ দিলেন। সেখানে বললেন, তিনি চান না তাঁর জন্য এএনসিতে বিভক্তি তৈরি হোক কিংবা সহিংসতায় একজন মানুষ মারা যাক। তাঁর এই কথাগুলোতেই ছিল এক অদ্ভুত বিভক্তির সুর। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তিনি আর যা-ই করুন, দলের বা জাতির ঐক্য ধরতে কিছুই করেননি।

সিএনএন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

কেভিন ব্লুম: দক্ষিণ আফ্রিকার ডেইলি মাভেরিক-এর করেসপনডেন্ট অ্যাট লার্জ