সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক লেখায় বলেছেন, অন্যের কোলে কাঁধে চড়ে অগ্রসর হওয়াকে অগ্রসর হওয়া বলে না। নিজের শক্তিতে যে যত দূর যেতে পারে, সেটাই তার কৃতিত্ব। যোগ্যতায় ও কষ্টে অর্জিত আর দয়ায় প্রাপ্তি দুই জিনিস। বাংলাদেশের যখন অভ্যুদয় ঘটে তখনকার দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা পরবর্তী ১০-১৫ বছরে ব্যাপক বদলে যায়। 

১৯৭০ সালে নারীশিক্ষার যে হার ছিল, ১৯৮০ নাগাদ তা বহুগুণ বেড়ে যায় এবং ১৯৯০ নাগাদ মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছেলেমেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান দাঁড়ায়। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী ও উত্তীর্ণদের সংখ্যা প্রায় সমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ফলাফল ভালো। শুধু স্কুলপর্যায়ে নয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের অর্জন খুবই ভালো। সরকারি ও আধা সরকারি চাকরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মেধাতালিকায় নারীদের দেখা যায়। তাঁরা বিশেষ যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন কর্মক্ষেত্রে।
সরকারি চাকরির বিভিন্ন ক্যাডারে নারীর উপস্থিতি আজ চোখে পড়ার মতো। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ বিভাগ, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে নারী আজ প্রতিষ্ঠিত তাঁদের যোগ্যতায়। নারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক প্রচুর। স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্যে পর্যন্ত তাঁরা ভালো করছেন। বিভিন্ন চেম্বারের নেতাদের অনেকেই নারী। বাংলাদেশে নারী আজ পিছিয়ে থাকা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী নয়।
অনেক দিন থেকে নারী সংগঠন ও নাগরিক সমাজ থেকে আমরা দাবি করে আসছিলাম নীতিনির্ধারণে নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। তার ফলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ সংশোধন করে ২০০৮-এ বিধান করা হয় ২০২০-এর মধ্যে নিবন্ধিত সব দলের প্রত্যেক স্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য রাখতে হবে। তাতে আশা করা গিয়েছিল জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের সময় অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নারী থাকবেন। এবং তাঁরা পুরুষ প্রার্থীর মতোই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন রাখার চেয়ে এটাই উপযুক্ত গণতান্ত্রিক উপায়। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই পদ্ধতিই প্রচলিত, কোটা পদ্ধতি নয়।
জীবনের সব ক্ষেত্রে যদি নারী যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন, শুধু একটি ক্ষেত্রে কেন তাঁরা করুণার পাত্র হবেন? সে ক্ষেত্রটি হলো সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন। ১৯৭২-এর সংবিধানে ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা হয়। তখন একটি উপধারায় এ ঘোষণাও দেওয়া হয় যে ‘সংবিধান প্রবর্তন হইতে ১০ বৎসরকাল অতিবাহিত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ’ ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন কেবল নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং তাঁরা আইন অনুযায়ী পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। তখনকার আর্থসামাজিক অবস্থায় ১০ বছরের জন্য ১৫টি নারী আসন সংরক্ষিত রাখা এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পরোক্ষ ভোটে নির্বাচন খুবই স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত ছিল। সংবিধানপ্রণেতারা যথার্থই ধারণা করেছিলেন, পরবর্তী দশ বছরে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে, তখন আর সংরক্ষিত নারী আসন রাখার প্রয়োজন হবে না। নারীদের অনেকেই সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।
পঁচাত্তরের পর সামরিক শাসনের মধ্যে সংবিধানের এই ধারায় পরিবর্তন আনা হয়। যখন নারী সমাজের দ্রুত অগ্রগতি ঘটছিল, তখন মূল সংবিধানে একটি বড় পরিবর্তন আনার কী প্রয়োজন হলো, তার ব্যাখ্যা ছিল না। সামরিক ফরমান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র ৬ নম্বর সংশোধন আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা ‘১০ বৎসরকালের’ জায়গায় করা হয় ১৫ বছর এবং নারীদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩০।
এভাবে বহুসংখ্যক সংরক্ষিত আসনে আইয়ুব খানের পরোক্ষ পদ্ধতিতে নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা বিবেচনা করেননি। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ও সময় বাড়ানো হয়। প্রথম সংসদ যেমন তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি, তেমনি দ্বিতীয় সংসদও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত সাত্তার সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তাঁর সময়ে দুটি সংসদ গঠিত হয়। গণতন্ত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। গণদাবির চাপে তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ মাঝপথেই ভেঙে যায়। কিন্তু ৩০টি সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চিরকালের জন্য পরিচিতি পান ‘সাবেক সংসদ সদস্য’ বলে।
অষ্টম সংসদে সংবিধানের দশম সংশোধনী পাস হয়। সেই সংসদেই সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী গৃহীত হয়, যেখানে নারী আসনসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫। সবই করা হয় সরকারি দলের স্বার্থে এবং দলে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়াতে, নারীসমাজের অগ্রগতির প্রয়োজনে নয়। নবম সংসদের প্রথম অধিবেশন হয় জানুয়ারি ২০০৯-এ। সেই সংসদ ২০১১-এর ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করে। দশম সংসদের মেয়াদ আছে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত। সংরক্ষিত নারী আসনও ওই পর্যন্ত থাকার কথা। বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি, বাড়ি করার জন্য রাজধানীতে প্লট প্রভৃতি সুবিধা যত বাড়ছে, সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ও মেয়াদ তত বাড়ানো হচ্ছে।
নারী সংগঠন ও নারীবাদীদের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে দাবি ছিল প্রত্যক্ষ ভোটে নির্দিষ্টসংখ্যক নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের। সংরক্ষিত আসন রাখা বা বাড়ানোর দাবি কেউ করেননি। সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ বাড়ানোর দাবিও উঠেছে বলে কোনো কাগজে খবর দেখিনি। এর মধ্যে ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধনী) আইন, ২০১৮’ অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছে। তাতে প্রস্তাব করা হয়েছে, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ বাড়বে আরও ২৫ বছর। সংসদে এখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সরকারি দল। এই সংশোধনী যে কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই পাস হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা যদি হয়, তাহলে ২০৪৪ পর্যন্ত সংরক্ষিত নারী আসন থাকবে।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বর্তমান সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের বাইরে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য আছেন ২০ জন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৮ জন। সংরক্ষিত সংসদ সদস্যদের নিজস্ব এলাকা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কোনো এলাকার ‘দায়িত্ব’ দিয়েছেন। একই এলাকার নির্বাচিত সাংসদ ও সংরক্ষিত আসনের সাংসদের মধ্যে বিরোধ-সংঘাতের কথা কাগজে আসে। সংরক্ষিতরা জনগণের মনোনীত প্রতিনিধি নন, দলের বা দলের নেতার আস্থাভাজন। তাঁদের কেউ কেউ কোনো প্রয়াত নেতার স্বজন। তাঁদের কোনো জনসেবার অভিজ্ঞতা নেই। রাষ্ট্রপতির ভাষণ ও বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা সংসদ নেতাকে সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করেন না।
সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সাংসদ আর কোটার সাংসদকে জনগণ একই চোখে দেখে না। সরাসরি ভোটে যিনি নির্বাচিত তাঁকে মানুষ জানে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে। জনগণের কাছেও তাঁদের জবাবদিহি থাকে, তা যত অল্পই হোক। কোটায় যিনি সাংসদ তাঁর জবাবদিহি শুধু তাঁর কাছে, যিনি তাঁকে অনুগ্রহবশত সাংসদ বানিয়েছেন।
প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ধর্মীয় মৌলবাদী প্ররোচনার মধ্যেও বাংলাদেশে নারী প্রগতি অপ্রতিরোধ্য। সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বেশি থাকবে, সেটাও কাম্য। তবে নারী-পুরুষ সমানাধিকার ও সমমর্যাদার প্রশ্নে কোটাপদ্ধতি অমর্যাদাকর। ক্ষমতায়নে ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে নারীর ভূমিকা রাখতে হলে সংরক্ষিত নারী আসন না রাখাই যুক্তিসংগত।
সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক