এরশাদ-মায়া পারলে খালেদা কেন নয়?

জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। ঠিক এক বছর এক মাস আগে ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি রংপুরে নিজের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’ এরশাদের অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ার পর এখন দেশবাসীর অপেক্ষার পালা মঞ্জুর হত্যাসহ এরশাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো নিজস্ব গতিতে চলে কি না।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। জনতা টাওয়ার মামলায় আপিল বিভাগ এরশাদের সাজা বহাল রাখলে তিনি ২০০০ সালের ২১ ডিসেম্বরে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং মাননীয় বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। তাঁকে কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়ে চার দলের শীর্ষ নেতারা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে খালেদা জিয়ারও সই ছিল। আজ বিএনপি নেতারা যেমন বলছেন, সাজানো মামলায় খালেদাকে ফাঁসানো হয়েছে, সেদিন জাতীয় পার্টির নেতারাও দাবি করেছিলেন, চারদলীয় জোটে যাওয়ার কারণেই এরশাদ সরকারের রোষের শিকার হয়েছেন।

এখন এরশাদ নিজেকে যতই আওয়ামী লীগের বন্ধু দাবি করুন না কেন, সেই সময় বিএনপির সঙ্গেই তাঁর সখ্য ছিল। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিও শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছিল। তৎকালীন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সরকারি বাসভবন ২৯ মিন্টু রোডে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চার দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হক। গোলাম আযম ও আজিজুল হক মারা গেছেন। আর খালেদা এখন জেলে এবং এরশাদ শেখ হাসিনা সরকারের অংশীদার।

উল্লেখ্য, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা জবরদখলকারী এরশাদের পতন হয়। সেনানিবাসে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় তিনি বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উসকানিমূলক কথাবার্তা বললে ছাত্র-জনতা ক্ষুব্ধ হয়। একপর্যায়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার তাঁকে কারাগারে পাঠায়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও এরশাদ অংশ নেন কারাগারে থেকে। আর ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলা, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাওয়া উপহারসামগ্রী আত্মসাৎ-সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলাসহ তিনটি মামলায় নিম্ন আদালতে দণ্ডিত (সাজার মেয়াদ ৩ থেকে ১৩ বছর) ছিলেন। কিন্তু সেই দণ্ড ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিম্ন আদালতের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে এরশাদ নির্বাচন করেন এবং সংসদ সদস্য পদও বহাল রাখেন। নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর একাধিক মামলায় তিনি জামিন পেয়েছিলেন। তাঁর সংসদ সদস্য পদ তখনই খারিজ হয়ে যায়, যখন জনতা টাওয়ার মামলায় সর্বোচ্চ আদালত তাঁর সাজা বহাল রাখেন। এ কারণে এরশাদ ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।

১৯৯৬ সালেই নিম্ন আদালতের সাজার বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন উচ্চ আদালত। সে সময় এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিএনপিদলীয় প্রার্থী মইদুল ইসলাম হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার প্রশ্নে কোনো আদেশ দেননি। সেই মইদুল এখন এরশাদের দলের সাংসদ। একসময় তিনি জিয়ার মন্ত্রী ছিলেন। পরে এরশাদের মন্ত্রী হন। একবার আওয়ামী লীগের টিকিটেও নির্বাচন করেছিলেন। কত বিচিত্র বাংলাদেশের রাজনীতি!

এই প্রেক্ষাপটে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হওয়ার পর নানা প্রশ্ন সামনে এসেছে। কারাবন্দী হিসেবে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না, উচ্চ আদালত তাঁর আপিল গ্রহণ করলেও সাজা স্থগিত করবেন কি না, অন্য মামলায় তাঁকে আটক করা হবে কি না? খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩৪টি মামলা আছে, যার ৩০টিই বর্তমান সরকারের আমলে করা। আগামীকাল, অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ গঠনের কথা আছে। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় যুক্তিতর্ক উত্থাপনের তারিখ ধার্য আছে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি।

প্রশ্ন হচ্ছে, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে বিএনপি নির্বাচন করবে কি না; তারা নির্বাচন বর্জন করলে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না? এসব নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে যেমন সরগরম আলোচনা চলছে, তেমনি বিদেশিরাও কৌতূহল দেখাচ্ছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সংসদীয় দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে বৈঠক করে জানতে চেয়েছে, দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে থাকা খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না। জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘এটি আদালতের বিষয়। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই।’ বৈঠক শেষে প্রতিনিধিদলের নেতা জ্যাঁ ল্যামবার্ট বলেছেন, ইইউ বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। তবে তিনিও বলেছেন, মামলার বিষয়টি আদালত নিষ্পত্তি করবেন। এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে ‘সুষ্ঠু বিচার’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ শান্তি বজায় রাখার তাগিদ দিয়েছে। বিএনপি নেতারা মুখে ‘খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না’ বললেও ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি এবং পুলিশের অনুরোধে তিন ঘণ্টা আগে অনশন শেষ করা দেখে সেরকম ধারণাই  হয়।

সংবিধানের ৬৬ (২গ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাবাসে থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে যোগ্য হবেন না। খালেদার রায়ের পর আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে দুটি রায় আছে। আপিল চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত একটি রায় বলছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে, অন্য রায় বলছে যাবে না। এখন ওনার (খালেদা জিয়া) ব্যাপারে আপিল বিভাগ এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তাদের বিষয়।’ প্রশ্ন হলো, সর্বোচ্চ আদালত, অর্থাৎ আপিল বিভাগের রায়ের আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে কি না। অতীতে নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদ নির্বাচন করতে না পারার উদাহরণ নেই। অন্যদিকে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে নির্বাচন করা, সাংসদ ও মন্ত্রী পদে বহাল থাকার অনেক উদাহরণ আছে।

বিচারিক আদালতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর (মায়া) সাজা হয়েছিল, হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় খারিজ করে দেন। দুদক হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ খারিজ করে নতুন করে শুনানির নির্দেশ দেন। এর অর্থ হচ্ছে, মামলাটি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। কিন্তু সে কারণে মায়ার মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ যায়নি। আপিল করা অবস্থায় তিনি সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। কাজেই এখানে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর বিষয়টি একটি উদাহরণ হয়ে থাকছে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, ‘এই উদাহরণ ধরে এটা বলা যায়, উচ্চ আদালতে আপিল থাকলে কেউ নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার কথা নয়। নবম সংসদের সদস্য থাকা এবং যিনি বর্তমান সংসদেরও সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মামলার রায় ও এর ঘটনাপ্রবাহও আমাদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি (আওয়ামী লীগের) আবদুর রহমান বদির তিন বছর সাজা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আপিল চলমান, বাস্তবতা হচ্ছে, তিনিও সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। কাজেই নিম্ন আদালতে সাজা হলেই কোনো ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না, বিষয়টি চূড়ান্ত নয় বলে ধরে নেওয়া যায়।’

সাজা চূড়ান্ত করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের। নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টে সাজার ওপর নির্ভর করে অতীতে কারও সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়নি বা কাউকে সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পরও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও আবদুর রহমান বদি উচ্চ আদালতে আপিল করে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা এখন কেউ মন্ত্রী পদে, কেউ সংসদ সদস্য পদে অধিষ্ঠিত। সে ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে আপিল করে আগামী নির্বাচন করতে পারবেন না কেন?

কথাটি অন্যভাবেও বলা যেতে পারে, খালেদা জিয়া যদি নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ার কারণে নির্বাচন করতে না পারেন, তাহলে এরশাদ, মায়া, বদিকেও নিজ নিজ পদ থেকে সরে যেতে হবে।

এক দেশে তো দুই নিয়ম চলতে পারে না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি