ব্রেক্সিট নিয়ে যত ঝকমারি

যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগ সৌহার্দ্যপূর্ণ হবে বলে উভয় পক্ষ আশা ব্যক্ত করেছিল, কিন্তু তার উল্টোটা হচ্ছে। ৪৪ বছর ইইউর সঙ্গে থাকার পর গত বছরের ২৯ মার্চ ব্রাসেলসে জোটের বিধি অনুযায়ী থেরেসা মের সরকার জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পত্র পেশ করে। তারপর উভয় পক্ষ দেনা-পাওনা নিয়ে বারবার আলোচনায় বসেছে। আগামী দিনগুলোতে ইইউর সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন বা দেশগুলোর জনগণের কাজকর্ম ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা, ভ্রমণের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকবে কতটা থাকবে না, তা নিয়ে বিতর্ক বিবাদের পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইইউর বিধি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে জোটের অন্তর্বর্তীকাল দুই বছর। আর এই অন্তর্বর্তী সময়েই যুক্তরাজ্য জোটে না থেকেও জোটের সঙ্গে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে নতুন ধরনের চুক্তি করতে চায়। জোট সদস্যরা তা নাকচ করে দিয়েছে। সমস্যাটা সেখানেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে যখন জাতিতে জাতিতে অবিশ্বাস আর সন্দেহের দোলাচল, সেই সময় ১৯৪৬ সালে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ইউরোপে আমাদের একধরনের যুক্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা করা প্রয়োজন। ফ্রান্স ও জার্মানি এ ধরনের জোটের দায়িত্ব নিতে পারে।’ তবে তিনি নিজেদের ব্রিটিশ এম্পায়ার অব ইউনাইটেড স্টেট হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করেছিলেন।

১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলেও অনেক রক্ষণশীল এবং লেবার-দলীয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বা তাঁদের সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। জোটে ইউরোপীয় মুদ্রাব্যবস্থা এবং ভিসা প্রথায়ও তাঁরা নিজেদের যুক্ত করেননি, কিন্তু ইউরোপীয় একক বাজারব্যবস্থার সুফল ভোগ করেছেন। যুক্তরাজ্য শুধু এই জোটের বন্ধু ও সমর্থক হিসেবে নয়, ইউরোপীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে জোটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। জোটের মধ্যে ব্রিটিশদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আচরণে বিরক্ত হয়ে ১৯৮৩ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশরা আদতে ইউরোপে শুধু একটি দ্বীপরাষ্ট্র।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার কারণে যুক্তরাজ্যের কী ক্ষতি বা লাভ হচ্ছিল, এই বিষয়গুলো এখন আবার সামনে আসছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যাংক খাতে যুক্তরাজ্যের দৈন্যদশা নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। পুঁজি আর অর্থনৈতিক লাভের হিস্যা নিয়ে হঠাৎ আবেগতাড়িত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়া বিষয়ে খোদ যুক্তরাজ্যে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে।

৬ ফেব্রুয়ারি ইইউ পার্লামেন্টে সদস্যদেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, ২০১৯ সালের ২৯ মার্চের পর থেকে যুক্তরাজ্য ইইউ জোটে তাদের সব অধিকার হারাবে। তবে ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক ইউনিয়ন ও একক বাজারব্যবস্থার সুবিধা নিতে পারবে। এর সপ্তাহখানেক আগে ইইউর প্রধান সমঝোতাকারী মিশেল বার্নিয়ে যুক্তরাজ্য সফর করে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং ব্রেক্সিট-বিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড ডেভিসের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে ডেভিড ডেভিস বলেন, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় একক বাজার ত্যাগ করে ইইউ জোটের সঙ্গে একটি নতুন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে চায়। তা ছাড়া অন্তর্বর্তীকালে ইইউভুক্ত দেশগুলোর যেসব নাগরিক যুক্তরাজ্যে আসবেন তাঁদের মর্যাদা কী হবে, তা নিয়ে নতুন আইন করা হবে। অবশ্য মিশেল বার্নিয়ে সমান শুল্ক হারে বা কাস্টমস ইউনিয়ন চুক্তি ত্যাগ করে নতুন বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে দুরাশা ব্যক্ত করেছিলেন এবং ইউরোপিয়ান আদালতের নির্দেশ মানাসহ যুক্তরাজ্যকে সময় শেষ হওয়ার আগেই তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাগাদা দিয়েছিলেন।

থেরেসা মের মন্ত্রিসভায়ও ব্রেক্সিট নিয়ে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নানা মত রয়েছে। যুক্তরাজ্য ৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে ব্রাসেলসে ইইউ সদর দপ্তরে অন্তর্বর্তীকালীন জোটের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তারা আবার পিছিয়েছে ইইউর প্রধান সমঝোতাকারী মিশেল বার্নিয়ে যুক্তরাজ্যের বারবার এই সিদ্ধান্তহীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

জার্মানির ডের স্পিগেল লিখেছে, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ইইউ ত্যাগের কী প্রভাব পড়বে, তা যুক্তরাজ্য সরকার সব সময় আড়াল করেছে। তবে এক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জোট ত্যাগের ফলে আগামী ১৫ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে ৮ শতাংশ কমে যাবে। এ ছাড়াও ইইউ জোটের সঙ্গে বাকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে ৭৫০টি চুক্তি রয়েছে। ইইউ ত্যাগের ফলে যুক্তরাজ্যকে চুক্তিগুলো নতুন করে করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ ও জটিল।

৪৪ বছর ইইউ জোটে থাকার পর যুক্তরাজ্যের এই জোট ত্যাগের বিষয়টি উভয় অংশের সিংহভাগ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বিশেষ করে ইউরোপের তরুণ প্রজন্মের এই বিচ্ছেদ এক বড় আঘাত। 

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি