তেল-মবিলের মানুষ

‘মানুষের দরকার আছে, এই কথাটাই ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে, হাঁ করতে করতে, পৃথিবীর অধিকাংশকে গ্রাস করে ফেলেছে। প্রকৃতিও কেবল দরকারের সামগ্রী, মানুষও কেবল দরকারের মানুষ হয়ে আসছে।’ রবীন্দ্ররচনার এই অংশ যে পাতায় ছাপা, বই থেকে সে পাতা আলাদা করে রেখেছে পুরোনো একটা বুক মার্ক। তার ওপর লেখা, দিনটাকে অসাধারণ বানানোর সহজ উপায়। ১. মুখে সর্বদা হাসি রাখো, ২. স্বাগত জানাও, ৩. ধন্যবাদ জানাতে‍ অকৃপণ হও, ৪. দেখো এবং মন দিয়ে শোনো, ৫. প্রশংসা করো প্রাণ খুলে, ৬. সংযত থাকো, ৭. ভালো ভাবো, ভালো করো।

বইয়ের পাতার মাঝখানে সুদৃশ্য কাগজের টুকরোটি বিশেষ উপকারী। কোন পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাঠ করা হয়েছে, মনে রাখার চিহ্ন। এ ক্ষুদ্রাকৃতির কাগজের টুকরোটি বানানোর বেলায় মোটেও ক্ষুদ্র বিবেচনা করা হয়নি। একটা ক্ষুদ্র বিষয় কত গুরুত্ব দিয়ে ভাবা যায়। পৃথিবীতে তার উল্টো ঘটনাও রয়েছে। বহু মানুষ নিজেদের ক্ষুদ্রতা দিয়ে বৃহৎকেও ক্ষুদ্র বানিয়ে ফেলে।

মফস্বলে ঘরের দেয়ালে সূচিকর্ম ফ্রেমে বাঁধাই করে ঝুলিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল। সেগুলোকে পরিবারের আভিজাত্য, জ্ঞান, সংস্কৃতিভাবনা, সূচিশিল্পে দক্ষতার নিদর্শন ধরে নেওয়া হতো। ‘গৃহে মা নাই যার, জীবন আঁধার তার’। ‘যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি’। আরও একটি কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। এখনো মনে পড়লে ভেবে অবাক হতে হয়, পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ে মধ্যবিত্ত পরিবার কেমন ধারণার সঙ্গে সহমত ছিল। ফ্রেমে বাঁধানো কথাটা একটু লম্বা, তবু এখনো মুখস্থ—‘ঈশ্বরকে চিত্কার করিয়া ডাকিলেই যে তিনি তাহা শুনিতে পান, তাহা নহে। মনের ভিতর ডাকিবার ইচ্ছা উদয় হওয়ার পূর্বেই তিনি তাহা শুনিতে পান, যদি সে ইচ্ছা ইচ্ছার মতো হয়’। মনে করে অবাক লাগে, নিয়মিত পবিত্র কোরআন, নামাজচর্চা হওয়া বাড়িতে ঈশ্বর লেখা উচিত কি উচিত নয়, সে ভাবনা ছিল না।

ভালো কথার মধ্যে বসবাস হলে মানুষের ভালো থাকার কথা বা বলা চলে একজন মানুষের পক্ষে মন্দের দখলে চলে যাওয়া সহজ হয় না। কথা বলতে পারা আর সুন্দর করে কথা বলতে পারার প্রভেদ এখন তেমন নেই। এখন কথা বলতে হৃদয় লাগে না, মস্তিষ্কের প্রয়োজন পড়ে না। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, ‘তুমি যদি উড়তে না পারো, দৌড়াও। যদি দৌড়াতে না পারো, হাঁটো। যদি হাঁটাও সম্ভব না হয়, হামাগুড়ি দাও। যেভাবে, যেমন করে পারো তোমাকে সামনে এগোতে হবে।’ শুধু ভালো কথা নয়, অনুপ্রেরণা। অপ্রস্তুত, অসহায় মানুষ যা থেকে দামি জীবনদর্শন খুঁজে পায়। টেলিভিশন, সিনেমা, নাটক, ক্রীড়া, সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদি সৃজনশীল বিষয়ের চর্চা সাধারণের জীবনকে সমৃদ্ধ, সুন্দর করতে পারে। ভালোর পথ দেখাতে পারে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়ে গেছে। ওসবে আমাদের আগ্রহ কতটুকু আর কী মাত্রায় উদাসীনতা তৈরি হয়েছে, তা যথেষ্ট দৃশ্যমান।

উন্নত বিশ্বের বহু দেশে মানস উন্নয়ন, হতাশা থেকে মুক্তির জন্য, সাফল্যের সূত্র সন্ধান, অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য গাঁটের কড়ি খরচ করে জ্ঞানী মানুষদের ভাষণ শোনার রেওয়াজ আছে। সেসব ভাষণে মানুষের জীবন, সংকট, আশা, হতাশার বয়ান থাকে। সমস্যাগ্রস্ত মানুষ কীভাবে উদ্ধার পেতে পারে, তার দিকনির্দেশনাও থাকে। আমরা বিনে পয়সাতেও মূল্যবান কথা শোনা সময়ের অপচয় মনে করি। যদি স্বার্থের অনুকূল হয়, কান, ঘাড়, মাথা পেতে অমূল্য, অশ্রাব্য কথাও শুনতে রাজি। না শুনলেও শোনার ভান যেন নিখুঁত হয়, সে চেষ্টা ষোলো আনা থাকে।

বছরজুড়ে বোকা বাক্সে চলতে থাকে কথা–চালাচালির আনন্দ আয়োজন। তা কথার জোর ছাপিয়ে প্রায়ই গলার জোর, গায়ের জোরের দিকে ধাবিত হয়। বোকা বাক্সের পর্দায় সেসব হাঁ হওয়া কাণ্ড দেখে দালাই লামার একটা উক্তির কথা মনে হয়—‘অন্য মানুষের হাজার সীমাবদ্ধতার বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার চেয়ে নিজের যদি একটি সীমাবদ্ধতা থাকে, সে বিষয়ে সচেতন থাকা ও অতিক্রমের চেষ্টা সবচেয়ে জরুরি।’ খুবই সাধারণ একটা কথা, অন্যকে দোষারোপের আগে নিজে দোষমুক্ত হও। কতজনের পক্ষে তেমনটা পারা সম্ভব হয়? বাস্তবে দোষারোপের সংস্কৃতিকেই তো মাথায় তুলে গৌরববোধ করা চলছে।

অশোভন, অমার্জিত কথা, আচরণ আমাদের চারপাশে দাপিয়ে বেড়ায়। আমাদের কান-চোখ সয়ে নেওয়ার কায়দাকানুন শিখে নিয়েছে। শিখে বহুদূর যাওয়া যায়নি, যাবে না। সবকিছুর একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। সে প্রতিক্রিয়ায় সংবেদনশীলতা পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাচ্ছে জীবন থেকে। জনে জনে স্বার্থবাদী চরিত্র প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রেম, বিশ্বাস কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। অবিশ্বাস ও ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ থেকে মানুষে। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা, বুঝেও না বোঝা আর দেখেও না দেখার ভান করে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে মানুষ।

মন ভালো করার জন্য কয়েকটা প্রেরণাদায়ক সুবচন স্মরণ করা যাক। প্রথমটি আলবার্ট আইনস্টাইনের—‘তুমি যদি সার্থক জীবন চাও, লক্ষ্যে নিবিষ্ট হও, মানুষ বা বস্তুতে নয়।’ মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘চোখের বদলে চোখের ঝোঁক পৃথিবীকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে।’ পৃথিবী বিষয়ে লেভ তলস্তয়ের উক্তি—‘সবাই ভাবে পৃথিবীকে বদলে দেবে, কিন্তু কেউই নিজেকে বদলানোর কথা ভাবে না।’

উন্নত চিন্তাচেতনার মানুষেরা নানান বিষয়ে তাঁদের ভাবনার বিস্তার ঘটিয়েছেন। বরাবর মানুষের মঙ্গলই থেকেছে সবার ভাবনার কেন্দ্রে। মাদার তেরেসার একটি উক্তি—‘জ্ঞানের কথা সহজ ও আকারে ছোট হয়, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি হয় সুদীর্ঘ।’ উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, ‘মস্ত উগ্রবাদী সে, যে মত বদলানোয় একরোখা এবং কখনোই ভাবনার বিষয়ও বদলায় না।’ একই ভাবের খোঁজ পাওয়া যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক উক্তিতে—‘গোঁয়ার হৃদয় হচ্ছে অশিক্ষিত হৃদয়।’

বুদ্ধিমান মানুষেরা, আইনস্টাইন, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, মাদার তেরেসারা কী বলেছেন, কী ভেবেছেন, তা নিয়ে ভেবে মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটান না। তাঁরা বাস্তববাদী মানুষ, নিজেদের আকাশের উদিত সূর্যের ব্যক্ত-অব্যক্ত ভাষা চমৎকার বুঝে নিতে সব মনোযোগ ঢেলে বসে থাকেন। কর্তব্যপরায়ণ, দায়িত্বসচেতন, নিষ্ঠাবান, সৎ—এ রকম বহু দাবিতে ঝলমলে। আমরা বিশ্বাসের কথা বলি, নিজেদের বিশ্বাসের ভিত মজবুত, সে প্রমাণ দিতে পারি না। আমরা অহরহ উচ্চারণ করি নিষ্ঠা, সততার কথা অথচ আঙুল গলে যখন-তখন বেরিয়ে পড়ছে সে দুইয়ের বিপরীত।

মিথ্যায় দ্বিধাহীন আবার জোর দাবি, সত্য রক্ষায় অবিচল আমরা। আমরা বলতে সমষ্টি বুঝি না, বুঝি গোষ্ঠী। গোষ্ঠীর বাইরে যারা, তাদের মানুষ বিবেচনার চেয়ে শত্রু বিবেচনা করা আমাদের অধিক পছন্দের। সবকিছুর পেছনে এখন অঙ্কই মুখ্য। অঙ্ককষা জীবন প্রকৃতজনের বদলে স্বার্থের জন্য উপকারীজনদের অধিক মাত্রায় শ্রদ্ধাভক্তি দেখানো যোগ্যতা মনে করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উক্তি—‘ভক্তি করিতে যাহাদের লজ্জাবোধ হয় তাহাদের কোনো কালে মঙ্গল হয় না।’ চোখ দেখে অজস্র, তা থেকে মন গ্রহণ করে সামান্যই। মানুষের মনের স্বভাব মানুষের মতোই। বিচিত্র মানুষের বিলাস। চাহিদা তার অসীম। আপন শক্তির প্রতি সম্মান নেই, অর্জন করতে চায় যন্ত্র, কলের বল। আবেগ তুচ্ছ মনে করে। রক্ত–মাংসের মহিমা না বুঝে তেল-মবিলের যন্ত্র বনে যারা আধিপত্য ফলাতে চায়, তারা জানে, মানে ও বিশ্বাস করে—যন্ত্র মানুষের চেয়ে বিরাট, মানুষের চেয়েও প্রবল তার প্রতাপ। হ্যাঁ, আয়তনে বিরাটই, কিন্তু মস্ত অসহায়ও। কল যদি বল হারায়, যদি তার চাকা থামে, বন্ধ চাকা ঘোরাতে মানুষেরই প্রয়োজন।

আফজাল হোসেন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক