নারীর সাহিত্য নারীর ভাষা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

টিভির একটা অনুষ্ঠানে একজন নারী অনেক সংগ্রামের পর জীবনযুদ্ধে কীভাবে জয়ী হয়েছেন, সে গল্প বলছিলেন। তিনি দরিদ্র পিতা-মাতার তিন সন্তানের একজন। দুই ভাই, এক বোন। ভাই দুজন যে যার মতো সংসার করছেন আলাদা হয়ে। তাঁরা মা-বাবার খোঁজখবর নেন না। নিজের সংসার সামলিয়েও বৃদ্ধ মা-বাবার দেখভাল করছেন নারীটি। তিনি বললেন, ‘আমিই এখন আমার মা-বাবার ছেলে।’

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পিতা-মাতাকে দেখভালের দায়িত্ব পুত্রের। সে কারণেই পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। ভার্যার কাজ পুত্র জন্ম দেওয়া। আবার বংশ রক্ষার জন্যও পুত্র চাই। বংশ তো একটা বিমূর্ত বিষয়, তার আবার রক্ষা কী? বংশ মানে আসলে সম্পত্তি। মেয়ে পরের ঘরে গিয়ে বংশের বাতি পয়দা করতে পারলে ভালো, না হয় সারা জীবন গঞ্জনা-নির্যাতনের শিকার হওয়া। কিন্তু বিত্তহীনদের তো কোনো সম্পত্তি নেই। তবু কেন পুত্রের প্রত্যাশী? কারণ, সেই চিরকালীন বিশ্বাস—পুত্রই মা-বাবার ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু টিভিতে কথা বলা মেয়েটির মতো সামাজিক চিত্র এখন আর দুর্লভ নয়। যে ভাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বৃদ্ধ, অক্ষম, অসহায় পিতামাতাকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে রেখে যায় আর তাঁদের সব দায়িত্ব নেয় যে বোন, তাঁকে কেন বলতে হবে—‘আমি এখন আমার মা-বাবার ছেলে?’ অনেকেই উপযুক্ত পুত্র থাকা বৃদ্ধদের অসহায়ত্ব দেখে বলে বসেন, ‘ছেলে ওদের ভালোই ছিল, বদমাশ হচ্ছে বউটা। কিছুতেই এখানে ভিড়তে দেয় না।’ শেষ পর্যন্ত যত দোষ নন্দ ঘোষ।

ভাষার মাস। মেলায় প্রতিদিন নতুন নতুন বই আসছে। নারী-পুরুষ (তৃতীয় লিঙ্গের কারও বই আসছে কি না জানি না) সব লেখকের বই। নারী লেখকেরা এখনো কেউ কেউ লেখিকা সম্বোধনে গোসসা করেন। লেখক বললে খুশি হন, না হলে নারী লেখক। যেন নারী হওয়া বড় বিড়ম্বনার বিষয়! লেখকের সঙ্গে ই-কার যোগে লেখিকা সম্বোধনে অসম্মান বোধ করলেও নারী শব্দটিও যে নর থেকে ঈ-কার যোগে উদ্ভূত, তা মনেই করেন না। এত পুরুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কেন? সন্তানেরা মাকে যদি ‘বাবা’ বলে ডাকে, তাহলে কেমন লাগবে?

শিল্পসাহিত্যে নারীর পদচারণ বেড়েছে। সাহিত্যে নারী লেখকের ভাষা ব্যবহার নিয়ে ইদানীং আরেকটি ডিসকোর্সের অবতারণা হয়েছে। নারীর ভাষা কেমন হওয়া উচিত-অনুচিত এসবের নির্ধারিত বেড়াজাল ডিঙিয়ে নারী তাঁর নিজের মতো লিখে চলেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বয়োজ্যেষ্ঠ খ্যাতনামা সাহিত্যিকেরা উদীয়মান প্রতিশ্রুতিশীল লেখিকাদের সাহিত্যের ভাষা নিয়ে অসন্তুষ্ট। তাঁরা নারীর বিষয় ভাবনায় খুশি হন, কিন্তু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বলেন যে নারী কেন এ ভাষায় লিখবে? যেমন গালিগালাজ কিংবা প্রেম, অনৈতিক সম্পর্ক ও যৌন দৃশ্যের বর্ণনা-সংলাপ কেবল পুরুষ লেখকেরাই ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারেন, ওগুলো নারী লেখকের ভাষায় উঠে এলে তাকে সুশীল নারী মানতে কষ্ট হয়। তখন আবার সবাই আদাজল খেয়ে সে লেখিকার ব্যক্তিগত জীবন হাতড়াতে থাকেন। এ লেখিকা নিশ্চয় হয় ডিভোর্সি, নয় অবিবাহিত বা খোঁজ নিয়ে দেখো কোনো কেলেঙ্কারি আছে জীবনে। এ ধরনের প্রথাবিরোধী লেখার জন্য নারীকে শুনতে হয়—‘এটা যে কোনো নারীর লেখা, তা মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরুষের লেখা।’ অনেকে আবার বেশ খুশি হন—বাহ্ তাহলে তিনি জাতে উঠেছেন! তার মানে ভালো যা, তা করবে পুরুষ।

মনে আছে মায়ের বেগম পত্রিকা লুকিয়ে পড়তাম ছোটবেলায়। যেসব লেখিকা তখন সনাতন নারীর জীবন কীভাবে স্বামী-সংসার-সন্তান নিয়ে আরও আদর্শস্থানীয় হতে পারে তার গল্প বলতেন, তাঁরাও বর্তমানে সে চিরচেনা গল্পের বৃত্তের বাইরের গল্প বলছেন। আর আজকের নারী তো যুগ যন্ত্রণায় নাজেহাল। কারণ শিক্ষা, শিল্পায়ন, কর্মজীবন, নাগরিক জীবন, অণু পরিবার, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সম্পর্কের জটিলতা ইত্যাদি সমাজের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। সে সমাজ নারী-পুরুষ-কিম্পুরুষ সব লেখকের লেখাতেই উঠে আসবে।

পুরুষ আর নারীর জীবনাচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। পুরুষ নারীকে যেভাবে দেখে, সে দেখায় নারী সন্তুষ্ট হতে পারছে না। পুরুষের চোখে নারী এক মায়াজাল। স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম চরিত্রম্ দেবা না জানন্তি। এসব মিথ থেকে বেরিয়ে এসে নারী যখন মানুষের মতো কথা বলে, তখন নারী হয়ে ওঠে পুরুষের সমকক্ষ, কখনো কখনো আরও অন্য রকম। যেটা পুরুষের পছন্দ নয়। তাই যখন পুরুষ বা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবসম্পন্ন লেখক-সমালোচক কেউ প্রশংসা করে নারী লেখককে বলেন, ‘আপনার লেখা পড়ে বোঝার উপায়ই নেই যে এটা কোনো নারীর লেখা’, তখন আহ্লাদিত না হয়ে বলুন—‘পুরুষ এখনো কেবলই পুরুষ এবং নারী হচ্ছে নারী ও পুরুষ উভয়ই।’ আর এ জন্যই সাহিত্যে নারীর ভাষাকে পুরুষালি ভেবে গ্রহণ বা বর্জনে বিতর্ক তুলে মাঠ গরম করার কিছু নেই। নারীর ভাষা মানুষের ভাষা। এতকাল অধিকাংশ পুরুষের সাহিত্যে যে খণ্ডিত নারী উঠে এসেছে, নারী সাহিত্যিক তাকে সম্পূর্ণ করার অঙ্গীকারে লেখনী ধরেছেন। রাষ্ট্র-সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন হবে আর সাহিত্যের নারীকে রাজপুত্র পাতালপুরি থেকে উদ্ধার করে দুয়োরানি বানিয়ে নটে গাছটি মুড়িয়ে দেবে, তা কি হয়?   

উম্মে মুসলিমা কথাসাহিত্যিক