কোটার অচলায়তন ভাঙতেই হবে

সরকারি চাকরিতে কোটা–ব্যবস্থার বিপক্ষের সংগঠনের ব্যানারে জড়ো হওয়া চাকরিপ্রার্থীরা। গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
সরকারি চাকরিতে কোটা–ব্যবস্থার বিপক্ষের সংগঠনের ব্যানারে জড়ো হওয়া চাকরিপ্রার্থীরা। গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

জনপ্রশাসন রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় একটি অপরিহার্য অঙ্গ। তাদের দক্ষতার ওপর দেশের শাসনব্যবস্থার মান ওঠানামা সম্পর্কিত। স্বাধীনতার পর থেকে এর নিয়োগপ্রক্রিয়া, বিশেষ করে বৈষম্যমূলক কোটা-ব্যবস্থা সতত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সমাজে ক্ষোভ সৃষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিক মেধাবীদের উপেক্ষা করে প্রাধিকার কোটায় কম মেধাবীদের নিয়োগের সুযোগ জনপ্রশাসনের দক্ষতা হ্রাসে ভূমিকা রাখছে বলে যৌক্তিকভাবে ধরে নেওয়া যায়। চাকরির সুযোগ লাভে সমতার যে সাংবিধানিক অঙ্গীকার, তার বিপরীতে যুগ যুগ ধরে ভিন্ন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর এর সম্প্রসারণ ঘটেছে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যও। এসব বিষয় নিয়ে সরকারিভাবে অনেক কমিটি-কমিশন হয়েছে। গবেষণা হয়েছে বেসরকারি পর্যায়েও।

সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এ বিষয়ে আগে কোটা-ব্যবস্থার বিপরীতে সোচ্চার অবস্থানে ছিল। এর প্রতিফলন ঘটত তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে। সংবাদপত্রের কলামে এ নিয়ে সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় অনেক লেখা হয়েছে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও এসেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে, কিন্তু হেরফের হয়নি অবস্থার। বর্তমান সরকারের ২০০৯-এর নির্বাচনী অঙ্গীকার দিনবদলের সনদে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রত্যয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। এমনকি ২০১২ সালে প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রে মেধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কোটা-ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের অঙ্গীকার বাস্তবায়নেরও কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন। তাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সদা প্রাসঙ্গিক থাকছে।

আমাদের সংবিধান বলছে, প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে সবার নিয়োগলাভের সমান অধিকার থাকবে। পাশাপাশি বাস্তবতা বিবেচনায় সংবিধানপ্রণেতারা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য কোটা সংরক্ষণের বিধানও রেখেছেন। অথচ এখন উচ্চতর সিভিল সার্ভিসের মেধার মাধ্যমে নিয়োগ পান ৪৫ শতাংশ প্রার্থী। এভাবে নিয়োগ হচ্ছে জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডারে। এর মধ্যে আছে প্রশাসন, কূটনীতিক, পুলিশ থেকে সরকারি কলেজের শিক্ষক আর চিকিৎসক। একইভাবে নিয়োগ হয় নিম্ন আদালতের বিচারক পদেও। তবে সামরিক বাহিনীর কমিশন্ড অফিসার পদে কোনো ধরনের কোটাই নেই। মেধাই সে ক্ষেত্রে নিয়োগের মাপকাঠি।

স্বাধীনতার পরপরই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে চালু হয় কোটা পদ্ধতি। কোটা আছে উপজাতি, মহিলা, জেলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। এর পরিমাণ ২৫ শতাংশ। আর মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের প্রাধিকার কোটা ৩০ শতাংশ। স্বাধীনতার পরপর শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়োগ দিতে কিছুকালের জন্য হয়তোবা এর যৌক্তিকতা ছিল। ছিল একটা আবেগাশ্রয়ী দিক। তবে একে স্থায়িত্ব দেওয়ার নৈতিক দিকটি প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের মধ্যে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির কেউ কিংবা সংখ্যাটি যৌক্তিক হলে সেটা মেনে নেওয়া যেত। এখন পর্যন্ত যত মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধিত হয়েছেন, তাঁদের পোষ্যের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য ৩০ শতাংশ চাকরির প্রাধিকারকে কীভাবে যৌক্তিকতা দেওয়া যায়? কোনো স্বাধিকার কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না থাকলে পদ খালি রাখার নির্দয় ব্যবস্থাও প্রায়ই নেওয়া হয়।

জেলা কোটাকে যেভাবে রাখা হয়েছে, তা অবাস্তব এবং নিয়োগদাতাদের কাজকে জটিল করে ফেলছে। সর্বশেষ জনগণনামতে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি জেলায় কোটা ভাগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে উন্নত জেলাগুলো কেন এই সুবিধার আওতায় আসবে তা বোধগম্য নয়। দেশের বিভিন্ন জেলার আর্থসামাজিক দিক বিবেচনায় নিচের দিকে থাকা কয়েকটি জেলাকে অনগ্রসর অঞ্চল বলে একটি কোটা সংরক্ষণ করা যায়। মহিলা কোটা আরও কিছুকাল রাখার প্রয়োজন রয়েছে।

উপজাতি কোটা দেশে তাদের সংখ্যানুপাতে অনেক বেশি। অন্যদিকে এর সুফল ভোগ করছে গোটা তিনেক তুলনামূলকভাবে উন্নত সম্প্রদায়। সাঁওতাল, মুন্ডার মতো সমতলের উপজাতিদের কোনো প্রতিনিধিত্ব সিভিল সার্ভিসে দৃশ্যমান হয় না। তাই এই কোটার পরিমাণ ও বিন্যাস নিয়ে কিছু ভাবনার আছে। কোটা-ব্যবস্থাকে সমূলে তুলে দেওয়ার জন্য হয়তো কেউ বলবে না। এটা ছিল অবিভক্ত ভারতে। ছিল পাকিস্তান সময়কালেও। এখনো ভারত ও পাকিস্তানে আছে। তবে তাদের সমাজকাঠামোর সঙ্গে আমাদের পার্থক্য ব্যাপক। ভারত বিভিন্ন জাতপাতে বিভক্ত দেশ। সেখানেও অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত কোটার প্রয়োগ হয় সতর্কভাবে। সেই শ্রেণিগুলোর কোনো প্রার্থীর পিতা-মাতার সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান একটি নির্ধারিত মানের নিচে না থাকলে তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। আর কোনো সদস্য এই কোটা-সুবিধা ভোগ করলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম এটা করতে পারে না। এ ছাড়া যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা নিয়েও আছে ব্যাপক ক্ষোভ। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সংস্কার করা হয় সেখানে।

বিশ্ব ছোট হয়ে আসছে। আমরা প্রায় প্রতিটি বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজের ভাগ বুঝে নিতে হলে মেধার দাপট প্রয়োজন। আর তা করতে হলে প্রতিটি চাকরিতে সর্বোচ্চ মেধাবীদের স্থান দেওয়ার দাবিই তো যৌক্তিক। পাশাপাশি তাঁদের প্রতি অব্যাহতভাবে অবিচার করে দূরে ঠেলে দিয়েই বহুমাত্রিক বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি করা হচ্ছে।

বলা হতে পারে, শুধু মেধাবী হলেই তাঁরা ভবিষ্যতের ভালো কর্মকর্তা হবেন, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। কথাটি সব ক্ষেত্রে অমূলক না-ও হতে পারে। নিয়োগের পর তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত স্থানে পদায়ন এবং প্রভাবমুক্ত পরিবেশে আইনানুগভাবে কাজ করার সুযোগ আর প্রয়োজনীয় তদারকি একজন দক্ষ কর্মকর্তা তৈরির জন্য নিয়ামক। তবে গোড়াতেই অধিকতর মেধাবীদের বাদ দিয়ে কম মেধাবীদের নিলে সমস্যার সূচনা এখান থেকেই হবে। আর তা-ই হয়ে চলেছে দীর্ঘকাল। ফলে গোটা বেসামরিক শাসনব্যবস্থার নিম্নমুখী মান লক্ষণীয়। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো। প্রতিকার হিসেবে ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া হয়। সেই সব প্রশিক্ষণও কিছু কর্মকর্তার গ্রহণ করার সামর্থ্য নেই, এমনটাও দেখা যায়। এর প্রধান কারণ মেধার ঘাটতি।

চলমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে অনেক কমিশন-কমিটি কাজ করার বিষয়ে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ পিএসসি ২০০৮ সালে ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় দুজন সাবেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তার মাধ্যমে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। তারা গোটা ব্যবস্থাটিকে অন্যায্য এবং জনপ্রশাসনের জন্য
ক্ষতিকর বলে মতামত দেয়। সুপারিশ রাখে প্রাধিকার কোটায় বড় ধরনের হ্রাসের। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইজিএস একটি গবেষণামূলক নিবন্ধেও অনুরূপ সুপারিশ রয়েছে।

আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো কোটাই একেবারে বিলুপ্ত করা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে সরকারের অঙ্গীকার অনুসারে মেধা কোটা যৌক্তিক পরিমাণে বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে পরিমাণটা কত হবে, তা নিয়ে বিতর্ক হবে। যদি বলা হয় সেটা শতকরা ৮০ হতে হবে, তাহলে আদৌ অন্যায্য হবে না। সব কোটাই সাকল্যে ২০ শতাংশে সীমাবদ্ধ করতে হবে। এটা সম্ভব ও সমীচীন। আমরা রাষ্ট্রের জনগণের করের টাকায় তাদের সিংহভাগকে চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চলেছি। অধিকতর মেধাবীদের পাশে ফেলে টেনে তুলছি কম মেধাবীদের। এর পক্ষে কী যুক্তি আছে, তা কিন্তু কেউ জোর দিয়ে বলছেন না। আর বিপক্ষে যত যুক্তি-তর্ক থাকুক, তা হচ্ছে উপেক্ষিত।

জনপ্রশাসনকে উপেক্ষার খেসারত রাষ্ট্র দিয়ে চলেছে। জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে যথোপযুক্ত তথ্যসমৃদ্ধ পরামর্শ প্রদান, তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অদক্ষতা স্পষ্ট দৃশ্যমান। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিষয়াদিতে দর-কষাকষিতে আমরা কাম্য সাফল্যের ছাপ রাখতে পারছি না। এর অনেক কারণ আছে। প্রশাসনে ব্যাপক রাজনীতিকীকরণ তার মধ্যে একটি বড় নিয়ামক। পাশাপাশি জনপ্রশাসনে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে মেধার মূল্যায়নও যথার্থভাবে হচ্ছে না; নিয়োগকালে তো নয়ই। এভাবে আর কতকাল চলবে তা বোধগম্য হচ্ছে না। তবে অচলায়তন একসময় ভাঙতেই হবে। 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব