প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে হবে

৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে হবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

সহযোগিতায়:

আলোচনায় সুপারিশ

  • প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে নবজাতকের মৃত্যু কমানোর অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন
  • সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানসম্মত প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করতে হবে
  • সব প্রসব দক্ষ মিডওয়াইফের উপস্থিতিতে করানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন
  • নবজাতক মৃত্যুর প্রধান চারটি কারণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে
  • স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে
  • স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সেবার মানোন্নয়ন জরুরি
  • গ্রামীণ অঞ্চলের গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম: নবজাতকের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা আগে ততটা চিন্তা না করলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে নবজাতকের মৃত্যুহার কমানো এবং প্রতিটি নবজাতক যেন সুন্দর জীবন পেতে পারে, সে বিষয়ে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছি।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমানো এবং নবজাতকের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বিষয়ে কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাস করতে এবং প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে আমাদের কী করণীয়, সে বিষয়েই আজকের আলোচনা।

মো. শহীদুল্লাহ
মো. শহীদুল্লাহ

মো. শহীদুল্লাহ: নবজাতক মৃত্যুর তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে। এগুলো হলো অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া, জন্মের সময় জটিলতা এবং বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ। এই তিন কারণে প্রধানত জন্মের প্রথম ২৮ দিনের মধ্যে নবজাতক মারা যাচ্ছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে যত নবজাতক মারা যাচ্ছে, তার অর্ধেক জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। আর জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যাচ্ছে এমন নবজাতকের ৭৩ শতাংশ মারা যায় বাড়িতে প্রসবের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, একটি শিশু যখন বাড়িতে জন্ম নিচ্ছে, তখন তার যদি কোনো জটিলতা দেখা দেয়, সেটি মোকাবিলা করার মতো ব্যবস্থা বাড়িতে না থাকার কারণে নবজাতকটি মারা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে সন্তান প্রসবের হার আমাদের দেশে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধি আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আশানুরূপভাবে হয়নি। ২০১০ সালে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ১০ শতাংশ প্রসব হতো, এখন তা বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। অপর দিকে বেসরকারি হাসপাতালে প্রসবের হার ১১ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য অনেক বেশি। বর্তমানে ৯৩ শতাংশ ধনী পরিবারের গর্ভবতী মায়েরা গর্ভকালীন সেবা গ্রহণ করছেন, কিন্তু দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ৫১ শতাংশ। ধনী পরিবারের ৭৮ শতাংশ প্রসব দক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে হচ্ছে, কিন্তু দরিদ্রদের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ দক্ষ দাইয়ের কাছে যাচ্ছেন।  ধনী ও দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে বিশাল এই বৈষম্য আমাদের দূর করতে হবে।
দেশের প্রতিটি জেলা হাসপাতালে নবজাতকের জন্য বিশেষ যত্ন বিভাগ বা স্ক্যানু সুবিধা চালু করা সরকারের একটি লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ পর্যন্ত দেশের ৪৪টি জেলা হাসপাতালে স্ক্যানু সুবিধাটি চালু করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ২০টি জেলায় এই সুবিধা দ্রুত চালু করা দরকার।

মো. আবদুল মান্নান
মো. আবদুল মান্নান

মো. আবদুল মান্নান: নবজাতকের মৃত্যুর কারণ প্রধানত তিনটি, নবজাতক জন্মের পর না কাঁদা, স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা এবং নবজাতকের সংক্রমণ বা সেপসিস। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই তিনটি কারণে নবজাতকের মৃত্যু রোধ করার জন্য আমাদের স্বল্প খরচে সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার।

ইতিমধে্য আমাদের কাছে কার্যকর, স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ ও সহজ একটি সমাধান আছে । এই সমাধান হলো ক্যাঙারু মাদার কেয়ার। স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা নবজাতক তার দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে না। মায়ের ত্বক থেকে তাপমাত্রা নবজাতকের দেহে দেওয়ার জন্য স্বল্প ওজনের নবজাতককে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বুকের মাঝখানে রাখতে হয়। এটিকেই বলা হয় ক্যাঙারু মাদার কেয়ার।

ক্যাঙারু মাদার কেয়ারের মাধ্যমে স্বল্প ওজনের নবজাতককে বাঁচানো সম্ভব, আবার তাকে সংক্রমণ বা সেপসিস থেকেও সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। ফলে জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাস করতে আমাদের অনেক ব্যয়বহুল প্রযুক্তি বা চিকিৎসাব্যবস্থার দরকার নেই।

নবজাতকের মৃত্যু ঠেকাতে আমাদের প্রয়োজন জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতককে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার দেওয়া, মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, নবজাতকের গোসল দেরি করে করানো এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক ছয় ধাপের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা। এই সাধারণ ও সহজ প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করলেই আমরা প্রায় ৭৫ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাস করতে পারি।

খালেদা ইসলাম
খালেদা ইসলাম

খালেদা ইসলাম: জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে কাজ করার সময় আমরা তিনটি ধাপে কাজ করছি। তিনটি পর্যায়ে আমরা নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাস এবং নবজাতকের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি।

প্রথমত, আমরা এলাকাভিত্তিক গর্ভবতী মা ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছি, যেন তাঁরা প্রসবের সময় হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন। বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা এবং পরামর্শদানের মাধ্যমে সব এলাকায় এমন একটি পরিবেশ আমরা তৈরি করতে চাই, যেখানে পরিবারের সদস্যরাই গর্ভবতী মাকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসবেন।

দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশের সব অঞ্চলে গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চাই। আমরা চাই প্রতিটি এলাকায় যেন অন্তত একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে পারি, যেখানে গর্ভবতী মায়েরা এসে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য পরামর্শ নিতে পারেন। যেকোনো জটিলতায় যেন দ্রুত তাঁদের উন্নত হাসপাতালে নেওয়া যায়, সেই সুবিধা নিশ্চিত করতেও  কাজ করছি।

আর তৃতীয় পর্যায়ে আমরা চাই অন্তত জেলা পর্যায়ে উন্নত সুযোগ-সুবিধাসহ একটি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে, যেখানে গর্ভকালীন যেকোনো জটিলতায় আমরা চিকিৎসা দিতে পারব। এরই অংশ হিসেবে দেশের প্রতিটি জেলা হাসপাতালে স্ক্যানু সুবিধা চালু করার কাজ করছি।

ফরিদ উদ্দিন আহমদ
ফরিদ উদ্দিন আহমদ

ফরিদ উদ্দিন আহমদ: মা ও শিশু সুরক্ষায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ১৯৭৫ সাল থেকে কাজ করলেও এ বছরই প্রথমবারের মতো অধিদপ্তরের কার্যসূচিতে নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়েছে।

নবজাতকের মৃত্যুহার কমাতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে গর্ভবতী মা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাটা খুবই জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকদের মাধ্যমে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য কর্মসূচির আলোকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে আমরা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। ইতিমধ্যে আমরা প্রয়োজনীয় জনবল তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি। ১৫৪ জন চিকিৎসককে আমরা বিশেষভাবে নবজাতকের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি এবং আরও ১৪৪ জন চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ চলছে।

নবজাতকদের বিপদচিহ্নগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে এবং নবজাতকদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে আমরা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রচারণার মাধ্যমে নবজাতকের প্রতি যত্ন নেওয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আমরা উদ্বুদ্ধ করতে চাইছি।

জাহেরা খাতুন
জাহেরা খাতুন

জাহেরা খাতুন: নবজাতকের জীবন বাঁচাতে একজন নার্স বা মিডওয়াইফ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। একজন মিডওয়াইফ যদি গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে নবজাতকের জন্মের পর শ্বাস-প্রশ্বাসসংক্রান্ত জটিলতা দ্রুত চিহ্নিত করার মাধ্যমে  প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এ কাজের জন্যই একজন মিডওয়াইফকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে।

একটি নবজাতক বাড়িতে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেখানেই জন্মাক না কেন, জন্মের ঠিক পরপর তার কিছু অত্যাবশ্যকীয় যত্ন নিতে হয়। এই যত্ন নেওয়ার কাজটি একজন দক্ষ মিডওয়াইফ করে থাকেন। জন্মের সঙ্গে নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করা, সংক্রমণ রোধে পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা করা, নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা এবং সর্বোপরি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নবজাতককে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব একজন মিডওয়াইফ পালন করে থাকেন।

সন্তান জন্মদানের পর একজন মায়ের পক্ষে তাঁর নবজাতককে এই অত্যাবশ্যকীয় সেবাগুলো দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তাঁর পাশে অবশ্যই একজন দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ থাকতে হবে। নবজাতকের মৃত্যুহার কমাতে হলে প্রতিটি প্রসবের সময় যেন একজন দক্ষ মিডওয়াইফ উপস্থিত থাকেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে সারা দেশের প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের সমন্বিত উদ্যোগে মিডওয়াইফদের প্রশিক্ষণ ও পদায়নের কাজ শুরু হয়েছে।

আহমদ এহসানূর রহমান
আহমদ এহসানূর রহমান

আহমদ এহসানূর রহমান: ২০১৭ সাল থেকে স্বাস্থ্য খাতে বিভাগওয়ারি কর্মসূচি (সেক্টর প্রোগ্রাম) শুরু হয়। এই কর্মসূচির শুরুতে নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১২টিতে কমিয়ে আনার জন্য ঠিক কী পরিমাণ অর্থ দরকার, আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেটি জানার প্রয়োজন হয়। আইসিডিডিআরবি এবং অন্য উন্নয়ন-সহযোগীরা মিলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হয়ে এই অর্থের একটি হিসাব করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

আমাদের হিসাবমতে, নবজাতকের মৃত্যুহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনতে হলে অতিরিক্ত ৭২০ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে আমরা দেখতে পাই। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত আরও ৭২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে প্রতিটি নবজাতককে বাঁচাতে সরকার যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, সেটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

এই হিসাবের ভিত্তিতে সরকার স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাসের জন্য কাজ করতে ইতিমধ্যে ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

 স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অন্যান্য প্রকল্প ও কর্মসূচিতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া আছে। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে আমাদের নবজাতকের মৃত্যুহার দরিদ্র পরিবারের মধ্যে বেশি। তাই সরকারের বরাদ্দকৃত এই প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচের ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে হাসপাতালে এসে সন্তান জন্মদানের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ অঞ্চলের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

সাব্বীর আহমেদ
সাব্বীর আহমেদ

সাব্বীর আহমেদ: যেহেতু ৫০ শতাংশের বেশি প্রসব বাড়িতে হচ্ছে, সেহেতু এখানে নবজাতকের মৃত্যুহার কমাতে স্থানীয় কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবকেরা ভূমিকা রাখতে পারেন।

আমাদের দেশে যে কমিউনিটি ক্লিনিক অবকাঠামোগুলো রয়েছে, সেখানে কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার একটি বিষয় বলা আছে। আবার স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও পরিবারকল্যাণ অধিদপ্তরের যে সেক্টর প্ল্যান আছে, সেখানেও কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কথা বলা হচ্ছে।

তাহলে আমরা স্থানীয় পর্যায়ে নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় সেবা নিশ্চিত করার জন্য এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে এই কমিউনিটি সদস্যদের ব্যবহার করতে পারি। আমাদের পোলিও দূরীকরণ কর্মসূচিতে দেখেছি যে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে কমিউনিটি সদস্যদের ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকর।


আবু সাইদ মোহাম্মদ হাসান
আবু সাইদ মোহাম্মদ হাসান

আবু সাইদ মোহাম্মদ হাসান: বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও এটি এখনো অনেক বেশি। আর আমাদের দেশের সামাজিক নানা কারণে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি রোধ করা কঠিন হবে। বাল্যবিবাহের সঙ্গে নবজাতকের মৃত্যুহার সরাসরি জড়িত।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের ২০১৪ সালের তথ্যমতে, দেশে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী যত বিবাহিত কিশোরী রয়েছে, তার ৩১ শতাংশ হয় বর্তমানে গর্ভবতী অথবা ইতিমধ্যে সন্তান ধারণ করেছে। এই তথ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে দেশের গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে বিরাট একটা অংশ কিশোরী। আর মেয়েরা যখন অল্প বয়সে গর্ভধারণ করে, তখনই নবজাতকের বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়, যা মা ও নবজাতক উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক।

অল্প বয়সে গর্ভধারণের হার শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বেশি এবং ধনী পরিবারের চেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোতে বেশি। তাই নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাস করতে হলে অবশ্যই দেশের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

গ্রামে একটি মেয়ে যখন অল্প বয়সে গর্ভধারণ করে, তখন দেখা যায় যে সে পারিবারিক ও সামাজিক নানা কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসে না। আবার প্রসবের সময়ও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় না। ফলে মা ও নবজাতক উভয়েই মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে।

ফিরোজা বেগম
ফিরোজা বেগম

ফিরোজা বেগম: নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো জন্মগত ত্রুটি। গর্ভকালীন গর্ভবতী মায়ের পরিপূর্ণ পুষ্টির অভাব নবজাতকের জন্মগত ত্রুটির প্রধান কারণ। যেহেতু আমাদের দেশের সিংহভাগ মা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করছেন, তাই এই অল্পবয়সী মায়েদের পুষ্টির অনেক ঘাটতি থেকে যায়। আর এই পুষ্টির ঘাটতি নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা কিশোরী মায়েদের গর্ভধারণকে বিলম্বিত করতে পারি। একটি মেয়ে যেন ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেলেও ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ না করেন, সে বিষয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

এ ছাড়া গ্রামীণ অঞ্চলের গর্ভবতী মায়েদের গর্ভ ও প্রসবের সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার করতে পারি। এলাকাভিত্তিক গর্ভবতী মায়েদের চিহ্নিত করে সঠিক সময়ে সেই মায়ের এবং তাঁর স্বামীসহ পরিবারের সদস্যদের মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠাতে পারি যে গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে পরীক্ষা করানোর সময় হয়েছে।

আমাদের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো তেমন নারীবান্ধব নয়। সরকার প্রতিটি হাসপাতালে গর্ভবতী মায়েদের জন্য পৃথক বিভাগ তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে, এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকতে হবে। হাসপাতালে সেবার মান বাড়াতে পারলে গর্ভবতী মায়েরা এমনিতেই হাসপাতালে আসতে উৎসাহী হয়ে উঠবেন।

এম এ কে আজাদ চৌধুরী
এম এ কে আজাদ চৌধুরী

এম এ কে আজাদ চৌধুরী: ২০০৯ সালে আমাদের নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এই নীতিমালায় একজন নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রতিটি বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। এ ছাড়া নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনার জন্য কীভাবে, কখন, কাদের এবং কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া আছে।

গর্ভবতী মায়েদের রক্তের গ্রুপের কোনো নমুনা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সংরক্ষণ করা হয় না। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় গর্ভবতী মা ও নবজাতকের জন্য। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে এই মায়েদের রক্তের গ্রুপের নমুনা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে যথেষ্ট উন্নতমানের সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তারপরও গর্ভবতী মায়েরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রসবের সময় আসছেন না। এর জন্য অনেকাংশেই সরকারি হাসপাতাল ঘিরে থাকা দালাল চক্র দায়ী। অনেক সময়ই হয়তো একজন গর্ভবতী মাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে, কিন্তু হাসপাতালের গেট থেকেই দালালদের প্রভাবে তারা বেসরকারি হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন। দালালদের এই দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। 

জিয়াউল মতিন
জিয়াউল মতিন

জিয়াউল মতিন: এ বছর প্রথমবারের মতো শুধু নবজাতকের স্বাস্থ্য খাতে পৃথকভাবে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য বিশাল একটি ব্যাপার। আমাদের সম্পদ সীমিত, এই সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে হবে। আর সেটি করতে হলে মানসম্মত সেবার কোনো বিকল্প নেই।

গত কয়েক বছরে নবজাতকের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ইতিমধ্যে আমরা মানদণ্ড ও দিকনির্দেশনা ঠিক করতে পেরেছি। এখন দেশের সব স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালে এই মানদণ্ড ও দিকনির্দেশনা অনুসারে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬২ হাজার নবজাতক জন্মের পর মারা যাচ্ছে। কিন্তু এর সমানসংখ্যক বা তার চেয়ে বেশি শিশু আমাদের দেশে মৃত জন্মগ্রহণ করছে। এ বিষয়টি প্রায়ই আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। নবজাতকের মৃত্যুহার কমানোর পাশাপাশি মৃত শিশুর জন্মহার কমানোর জন্যও আমাদের কাজ করতে হবে।

বিশেষ করে প্রসবের সময় সেবার মান নিশ্চিত করে আমরা মৃত শিশুর জন্ম কমিয়ে আনতে পারি। কারণ প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতায় বেশির ভাগ শিশুর মৃত জন্ম হয়। তাই গর্ভকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রসবের সময় মায়েদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা নিশ্চিত করে আমরা মৃত শিশুর জন্ম এবং নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে পারি।

মায়া ভেনদানেন্ট
মায়া ভেনদানেন্ট

মায়া ভেনদানেন্ট: শিশুমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাস করার ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য আমি প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাতে চাই। বিশ্বের যে অল্প কিছু দেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

আমরা ইউনিসেফের পক্ষ থেকে নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাসের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, কারণ এই মৃত্যুগুলো বেশির ভাগ সময়ই আমাদের নজরের আড়ালে রয়ে যায়। নবজাতকের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক সময়ই ততটা চিন্তা করি না। আমরা যতক্ষণ সময় ধরে এখানে বসে আলোচনা করছি, ততক্ষণে শুধু বাংলাদেশে অন্তত সাতটি নবজাতক মারা গেছে। হয়তো আরও সাতটি মৃত শিশুরও জন্ম হয়েছে। কিন্তু এই গুরুতর সমস্যাটি খুব সহজেই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।

নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাসের লক্ষ্যে আমরা যে বৈশ্বিক অভিযান শুরু করেছি এ বছর, তার মূল উদ্দেশ্য হলো এই সমস্যাকে সবার সামনে তুলে নিয়ে আসা। নবজাতকের মৃত্যুর বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমস্যা নয়। আমরা সবাই হয়তো এমন কাউকে চিনি, যে বর্তমানে গর্ভবতী বা সামনে গর্ভধারণ করবে। আমাদের পরিচিত সেই গর্ভবতী মা বা ভবিষ্যৎ গর্ভবতী মায়ের জন্য কিন্তু নবজাতকের মৃত্যুর সমস্যাটি একটি বড় সমস্যা। ফলে এটি নিয়ে আমাদের সবারই চিন্তা করা দরকার।

ইউনিসেফ থেকে আমরা চাই নবজাতকের মৃত্যু হ্রাসের লক্ষে্য সমাজের প্রতিটি মানুষ সচেতন হোক এবং চিন্তা করুক কীভাবে এই সমস্যা দূর করা যায়। শুধু সবার সচেতনতাই পারে নবজাতকের মৃত্যুহার একেবারে কমিয়ে আনতে। 

মো. শহীদুল্লাহ: হাসপাতালগুলোতে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি। বিশেষ করে দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে দুপুরের পরে যে চিত্রটি দাঁড়ায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।

দেশের সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেন মানসম্মত প্রসবকালীন সেবার নির্দেশনা মেনে প্রসব করার ব্যবস্থা থাকে, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আর আমাদের জেলা হাসপাতালগুলোতে যে স্ক্যানু সুবিধা স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো ঠিকমতো পরিচালনা করার জন্য আমরা দক্ষ জনবল পাচ্ছি না। এ বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে।

আবুল কালাম আজাদ
আবুল কালাম আজাদ

আবুল কালাম আজাদ: বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব সময় স্বাস্থ্য খাতের যেকোনো সমস্যার সমাধানে সরকারি, বেসরকারি, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসহ সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করে কাজ করে থাকে। এ জন্যই বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ নিয়েও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে।

আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, যেসব চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী দেখছেন, তাঁরাই কিন্তু আবার বেসরকারি হাসপাতালেও রোগী দেখছেন।

যখন তাঁরা সরকারি হাসপাতালে থাকছেন তখন তাঁদের ব্যবহার এক রকম থাকছে, আবার যখন তাঁরা বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন তখন তাঁদের ব্যবহার অনেক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের সেবার মান উন্নত করতে হলে আমাদের মানসিকতারও উন্নতি প্রয়োজন।

চতুর্থ সেক্টরাল কর্মসূচিতে আমরা প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে অন্তত ৫ জন করে সারা দেশে প্রায় ৬৫ হাজার বহুমুখী কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এই স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রতিটি এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গর্ভবতী মা, নবজাতকসহ সব মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নেবেন এবং প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসার পরামর্শ দেবেন।

কমিউনিটি ক্লিনিকে হয়তো আমরা কোনো মাকে ২৪ ঘণ্টা  রাখতে পারব না, কিন্তু প্রসব যদি সেখানে হয় তাহলে আমরা সেই মা বাড়িতে চলে গেলেও তাঁর খোঁজ রাখতে পারব। যেকোনো সমস্যায় তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারব।

জাহিদ মালেক
জাহিদ মালেক

জাহিদ মালেক: নবজাতকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে কিশোরী মায়েদের অল্প বয়সে গর্ভধারণ একটি বড় কারণ। অল্প বয়সে একজন মা গর্ভধারণ করলে তাঁর গর্ভের শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ হয় না, তাই জন্মের পর নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। আবার বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণে মায়েরা অপুষ্টিতেও ভোগেন। তাই নবজাতকের মৃত্যু বা মাতৃমৃত্যুর সমস্যার সঙ্গে অন্য অনেক বিষয় জড়িত। অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান করলে তা মাতৃমৃত্যু এবং নবজাতকের মৃত্যু কমিয়ে আনতেও সহায়ক হবে।

মায়েদের যদি আমরা শিক্ষিত করে তুলতে পারি এবং তাঁদের ক্ষমতায়ন যদি করতে পারি, তাহলে সেটিও নবজাতকের মৃত্যু কমিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করবে। কারণ নারীরা শিক্ষিত হলে এবং নারীর ক্ষমতায়ন হলে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন।

আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের মধ্যে এবং ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য অনেক বেশি। স্বাস্থ্য খাতে এই বৈষম্য একেবারেই কাম্য নয়। এই বৈষম্য আমাদের দূর করতে হবে। কিন্তু বৈষম্যের সঙ্গে সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা ও দারিদ্র্যের মতো বিষয়গুলোও জড়িত। তাই বৈষম্য দূর করার কাজটি কঠিন হবে, তবে অসম্ভব নয়।

আমাদের মায়েদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে প্রসব বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যে আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রসবকালীন সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সচেতনতার অভাবে মায়েরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আসছেন না। তাই মা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

আমাদের সম্পদ খুবই সীমিত। জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ নিয়ে আমরা স্বাস্থ্য খাতে কাজ করি। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ বরাদ্দ পায়। আমরা সীমিত সম্পদ নিয়েও  তাদের চেয়ে বেশি অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছি। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইউনিসেফের মতো আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি উন্নয়ন-সহযোগীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় অসুস্থ নবজাতকের সেবায় িবশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশের ৪৪টি জেলায় নবজাতকের বিশেষ সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এ বছরে আরও ২০টি জেলায় এই সেবা চালু করা হবে। কোনো ধরনের বিদেশি সহযোগিতা ছাড়াই সরকার এই উদে্যাগ নিয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে নবজাতকের মৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত।

আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সেই হারে আমাদের দক্ষ জনবল নেই। আর দক্ষ জনবল ছাড়া মানসম্মত সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। এখন আমাদের সেবার মান উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। আর সেবার মান উন্নয়নের সঙ্গে অবকাঠামো, দক্ষ জনবল ও মানসিকতার মতো বিষয়গুলো জড়িত।

তাই আমাদের সবাই মিলে সমন্বিত উদ্যোগে একসঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য খাতে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা উচিত। আমরা যে যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করলে নবজাতকের ও মাতৃমৃত্যুহার কমিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব বলে আমি আশাবাদী।

আব্দুল কাইয়ুম: নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে প্রসব করাতে মায়েদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম হিসেবে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যুহার কমাতে যা কিছু করা প্রয়োজন, প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমরা তা করব।

আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন

জাহিদ মালেক              :  মাননীয় সাংসদ, প্রতিমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়

আবুল কালাম আজাদ     :  মহাপরিচালক, ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মো. শহীদুল্লাহ               :  সাবেক প্রো-ভিসি অ্যান্ড হেড অব নিওনেটালজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

খালেদা ইসলাম            :  পরিচালক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এনএনএইচপি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মো. আবদুল মান্নান       :  চেয়ারম্যান নবজাতক বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম

ফরিদ উদ্দিন আহমদ      :  উপপরিচালক, সার্ভিসেস ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার

(নিউ বর্ন অ্যান্ড চাইল্ড) এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিট, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

এম এ কে আজাদ চৌধুরী :  মেম্বার সেক্রেটারি, বাংলাদেশ পেরিনেটাল অ্যাসোসিয়েশন

মায়া ভেনদানেন্ট           :  চিফ অব হেলথ, ইউনিসেফ

জিয়াউল মতিন             :  হেলথ ম্যানেজার, ইউনিসেফ

আবু সাইদ মোহাম্মদ হাসান :          টেকনিক্যাল অফিসার, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল

সাব্বীর আহমেদ           :  কর্মসূচি পরিচালক, নিউ বর্ন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ, মামনি এইচএসএস প্রকল্প, সেভ দ্য চিলড্রেন

ফিরোজা বেগম             :  সাধারণ সম্পাদক, ওজিএসবি

জাহেরা খাতুন              :  পরিচালক, অর্থ, সিনিয়র স্টাফ নার্স, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি সার্ভিস

আহমদ এহসানূর রহমান :  সহকারী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম              :  সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো