আসমার বিস্ময়কর সংগ্রাম

আসমা জাহাঙ্গীর
আসমা জাহাঙ্গীর

আসমা জাহাঙ্গীরের আকস্মিক মৃত্যুতে পাকিস্তানে থাকা তাঁর স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অনুসারীরাই যে শুধু ধাক্কা খেয়েছে তা নয়, ইতিবাচক ভাবমূর্তির একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধিকারকর্মী হওয়ার কারণে তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষও আঘাত পেয়েছে। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের এই সংগ্রামী নারীর সারা জীবনের কথা ও কাজ তাঁর সমর্থক ও নিন্দুক-উভয় পক্ষকেই নাড়া দিয়ে এসেছে। তাঁর মৃত্যুতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মৃত্যুর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে মানুষের আবেগপূর্ণ মন্তব্যের জট লেগে গিয়েছিল। দাফন অনুষ্ঠানে সহস্র মানুষের শোক ও সংহতির প্রকাশ দেখে বোঝা গেছে, পাকিস্তানের মানুষের হৃদয়ের কতখানি জুড়ে তিনি বিচরণ করছেন। সেনাশাসনের সমালোচনা করায় তাঁর বাবা মালিক গুলাম জিলানিকে যখন ইয়াহিয়া কারারুদ্ধ করেন, তখন আসমার বয়স মাত্র ১৮ বছর। এই বয়সেই তাঁকে সরকার সংগ্রামের পথে ঠেলে দেয়। তিনি সে সময় জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। বাবা শীর্ষ পর্যায়ের একজন রাজনীতিক হওয়ায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো রাজনৈতিক সংকটকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন।

আবদুল ওয়ালি খান ও ঘৌস বকশ বেজিনজোর মতো আরও অনেক গণতন্ত্রপন্থী নেতার সঙ্গে আসমার বাবাও পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল ভোটে জয়লাভ করা জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে চালানো সেনা অভিযানের বিরোধিতা করেছিলেন। এই সামরিক পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান ভাগ হয়ে যেতে পারে, এমন হুঁশিয়ারি তাঁরা আগেই দিয়েছিলেন। সেই সময়ে লাহোরে বসে এমন প্রচার চালানো হয়েছিল-পাঞ্জাবিদের উগ্র জাতীয়তাবাদী ক্রোধকে আমন্ত্রণ জানানো আর অন্ধ ঘৃণার রাজ্যে বাস করার নামান্তর।

পারিবারিক পটভূমির কারণে আসমা এবং তাঁর ভাইবোনদের বিদ্বেষের মুখে পড়ার বহু গল্প তাঁর ঝুলিতে ছিল। জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু অবধি তাঁকে স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানোর সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। সেই আশির দশকে প্রতিক্রিয়াশীল এক নায়ক জিয়াউল হক যখন পুরো দেশকে পশ্চাদ্গামী করে তুলছিলেন; ঠিক সেই সময় আসমা পাকিস্তানে একটি সংগঠিত আদিবাসী মানবাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। ধর্মীয় উগ্রবাদ তখন সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শকে আরও গভীরভাবে বসিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু নারীর প্রতি আইনগত ও সামাজিক বৈষম্য যখন পাকিস্তানের নারীদের একটি বড় অংশের কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো, তখন তারা, বিশেষ করে শহরের নারীরা আন্দোলন করতে রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নিল। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন আসমা।

অসাংবিধানিক ও জনবিরোধী শাসন ধরে রাখতে জেনারেল জিয়া যখন ইসলামি স্লোগান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ে গেল। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন গঠনের পর এ বিষয়গুলোকেই কমিশনের সামনে তুলে ধরা হয়।

সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের মূলধারায় তখন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আসমা। হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তানের (এইচআরসিপি) গোড়ার দিকে তিনি তাঁর পাশে পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন শ্রেষ্ঠ মানুষকে পেয়েছিলেন। মানবাধিকার আন্দোলন নিয়ে আসমার সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার, বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতে তাঁকে কখনো দ্বিধা করতে দেখিনি। এইচআরসিপির আন্দোলনের কারণেই পাকিস্তান থেকে বাঁধা মজুরেরা (বন্ডেড লেবার) আধুনিক ‘দাসপ্রথা’ থেকে মুক্তি পায়।

পৃথিবীর যেকোনো ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার এক অনুপম ক্ষমতা ছিল আসমার। সিন্ধুর প্রত্যন্ত থারপারকার ও বাদিন এলাকার নারী চাষিদের এগিয়ে আনতে কিংবা ফাটা প্রদেশের ঘালানি এলাকার নারী শিক্ষকদের উদ্দীপ্ত করতে তাঁর নেওয়া উদ্যোগগুলো ভোলার নয়। আসমা সাহসের সঙ্গে বেলুচিস্তানে সাধারণ মানুষের ওপর কর্তৃপক্ষের উৎপীড়নের প্রতিবাদ করেছিলেন।

২০০৬ সালের আগস্টে ডেরা বুগতি এলাকায় পরিদর্শনের সময় আমি তাঁর সহগামী হয়েছিলাম। সুই ডেরা বুগতি এলাকায় যাওয়ার জন্য আমরা যেই বেলুচিস্তানে ঢুকেছি, তখন আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হলো। সরকারের লোকজন ভেবেছিল, গুলির ভয়ে আসমা ফিরে আসবেন। কিন্তু দেখা গেল, এতে তাঁর সেখানে যাওয়ার জেদ আরও বেড়ে গেল। পরের দিন আমরা সুই বুগতিতে পৌঁছালাম এবং নওয়াব আকবর বুগতির সঙ্গে দেখা করলাম। আমরা সেখান থেকে আসার পর এক সেনা অভিযানে আকবর বুগতি নিহত হন। ওই এলাকা থেকে ফিরে আসমা বেলুচ নাগরিকদের ওপর সরকারের চালানো নির্যাতনের কথা সংবাদমাধ্যমকে জানান।

শান্তি ও গণতন্ত্রের সম্পর্কটিকে নিবিড়ভাবে বুঝতেন আসমা জাহাঙ্গীর। এ কারণেই তিনি সক্রিয়ভাবে শান্তি আন্দোলনে যোগ দিতে পারতেন। এ কারণেই তাঁর মৃত্যু সবাইকে নাড়া দিয়ে গেছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর ও আঞ্চলিক বিষয়াদির বিশ্লেষক