পরলোকগত শিক্ষামন্ত্রীদের গোলটেবিল

বর্তমান বাংলাদেশে সব পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র শুকনো পাতার মতো ওড়ে মাঠঘাটে। প্রশ্নপত্র পেয়ে বাপ-বেটা একত্রে উত্তর তৈরি করে অথবা মা-বেটি দৌড় দেয় কোচিংয়ের শিক্ষকের বাড়ি। কখনো পরীক্ষার পরে পরীক্ষার খাতা পাওয়া যায় পরীক্ষকের বাড়ির পাশের খালে, নয়তো বাজারের মুদি দোকানে। যার খাতা দিয়ে মুদি দোকানি গুড়ের পোঁটলা বানায় সে ঠিকই উপযুক্ত নম্বর পেয়ে সগৌরবে জিপিএ-৫ পায়। পত্রপত্রিকায় এসব সম্পর্কে এবং শিক্ষাজগতের দুর্নীতি নিয়ে দেদার লেখালেখি হলেও তা থামছে না এবং সম্ভবত থামবেও না। কীভাবে এসব খবর পৃথিবীর ওপার পৌঁছে গেলে কয়েকজন পরলোকগত শিক্ষামন্ত্রী বিচলিত বোধ করেন। তাঁরা আয়োজন করেন একটি গোলটেবিলের। সেই গোলটেবিলের বিবরণ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। সেটি হুবহু নিচে ছাপা হলো।

বাংলার পরলোকগত শিক্ষামন্ত্রীদের ভেতর শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রবীণতম। ১৯২৪ খ্রিষ্টীয় অব্দে লর্ড লিটন তাঁহাকে অবিভক্ত বঙ্গ প্রেসিডেন্সির শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তাঁহার পূর্বসূরি চব্বিশ পরগনা নিবাসী বঙ্গসন্তান পিসি মিত্তার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে কৃষিপ্রধান পূর্ববঙ্গের শিক্ষার উন্নতিকল্পে বিশেষ মনোযোগ প্রদান করিবার অবকাশ পান নাই। পূর্ববঙ্গের জেলাগুলি বরাদ্দ কম পাইত। হক মন্ত্রীর আসন গ্রহণ করিবার পর যেসব জেলায় বিদ্যালয় কম সেখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে তিনি শিক্ষার সর্বনাশ না ঘটাইয়া তাহার উন্নতি সাধন করিবার প্রয়াস গ্রহণ করেন। সেই কারণে তাঁহাকে পরলোকগত শিক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে পৌরোহিত্য করিবার জন্য প্রস্তাব করা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে তাহা গৃহীত হয়।

শেষনিশ্বাস ত্যাগ করিবার সময় শেরেবাংলার একটি দন্তও অবশিষ্ট ছিল না। সে কারণে তাঁহার উচ্চারণ অস্পষ্ট ছিল। প্রারম্ভিক বক্তব্য প্রদানকালে তিনি বলিলেন, কোনো জাতির জীবিতেরা যখন পচিয়া যায়, জাতির জন্য তাহাদের কিছুই করিবার অবশিষ্ট থাকে না, মৃতদের চাইতেও প্রাণহীন হইয়া পড়ে, তখন পরলোকগতদের অন্তত কিছু করিবার থাকে। যে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা দেড় শত বৎসর পূর্বে প্রবর্তিত হইয়াছিল আজিকে তাহা ধূলিসাৎ হইয়া গিয়াছে। জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ইহা অনিচ্ছাকৃত না পরিকল্পিত তাহা অন্তর্যামী ছাড়া আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। যত নিন্দা-প্রতিবাদ ততই বেশি প্রশ্নপত্র ফাঁস হইতেছে। পরীক্ষায় নকল ও শিক্ষা বিভাগে দুর্নীতি চলিতেছে দুর্বার গতিতে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের কর্ণকুহরে কেহ হয়তো সিসা ঢালিয়া দিয়াছে। এখন আমাদের কী করণীয় তাহা আপনারা আলোচনা করিয়া নির্ধারণ করুন।

একজন অখ্যাত মন্ত্রী পিছনে বসিয়া ছিলেন। তিনি কহিলেন, আমরা তো আর দুনিয়ায় যাইতে পারিতেছি না। সে পথ রুদ্ধ। কী আর করিতে পারি?

স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন শেরেবাংলার পার্শ্বেই বসিয়া ছিলেন। তিনি বলিলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস তো ব্যাধি নহে-উপসর্গমাত্র। প্রকৃত ব্যাধি হইল দুর্নীতি। যাহাই হউক, শিক্ষাব্যবস্থায় অরাজকতা সম্পর্কে কী করা যায় সে সম্পর্কে দুইজন বাঙালি কবির মতামত লওয়া যাইতে পারে।

শেরেবাংলা বলিলেন, সেলফোনে কবিগুরুকে ধরুন।

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ফোনে বলিলেন, আমিও আপনাদের মতো অতিশয় অশান্তিতে রহিয়াছি। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে কী রাখিয়া আসিলাম আর কী শুনিতেছি। আমার কুড়ি পঁচিশখানি সংগীত প্রতি প্রহরে গীত হইলেও আমার গদ্য, রচনাগুলি কেহ পাঠ করিবার প্রয়োজন বোধ করে না। তাহাতেই আমার শিক্ষাচিন্তা ব্যক্ত করিয়াছি। নিজে কখনো পরীক্ষা দিয়া পাস করি নাই। কাজেই প্রশ্নপত্র কি তাহা বলিতে পারিব না, সুতরাং ফাঁসের প্রসঙ্গই আসে না। মানুষ যখন নিজেই নকল মানুষে পরিণত হয় তখন পরীক্ষায় নকল হইবে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হইবে, খাতা না দেখিয়া অনুমানে নম্বর প্রদান করা হইবে, এমনকি পরীক্ষার ফিস জমা না দিয়াও গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাইবে।

ইহার পর ফোন লাগানো হইল বিদ্রোহী কবিকে, যিনি প্রমোশন পাইয়া জাতীয় কবির পদে আসীন হইয়াছেন। শিক্ষামন্ত্রীর ফোন পাইয়া কবি বলিলেন, আমি হইলাম স্কুল-পালানো ছাত্র। বিদ্যালয় হইতে পলায়ন করা পরীক্ষায় নকল করার চাইতে কম অপরাধ নয়। আপনাদের একালের সমমানের এসএসসি পাস করিবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। আমি হইলাম বেপাস মানুষ।

তবু তো আপনি আমাদের জাতীয় কবি। বর্তমান অবস্থায় কী করা যায় সে ব্যাপারে আপনার পরামর্শ আবশ্যক। নকল প্রতিরোধ বা প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কী করা যায় বলুন।

কবি বলিলেন, প্রশ্ন না করিলেই তাহা আর ফাঁস হইবে না।

ইহার অর্থ বুঝিলাম না।

কবি পরিষ্কার করিলেন তাঁহার বক্তব্য। কোনো প্রশ্নপত্র প্রণয়নের প্রয়োজন নাই। সব শ্রেণির পরীক্ষার্থীকে বলা হইবে আমার ‘বিদ্রোহী’ আর জসীমের ‘কবর’ কবিতা দুইটি পরীক্ষার খাতায় লিখিয়া দিয়া আসুক। যাহাদের একটিও বানান ভুল হইবে না, শুধু তাহারাই জিপিএ-৫ পাইয়া উত্তীর্ণ হইবে। তাহাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাবনা থাকিবে না বলিয়াই কবি এমন জোরে অট্টহাসি দিলেন যে যিনি ফোন করিয়াছিলেন তাঁহার বাম দিকের কানের পর্দা ফাটিয়া যাওয়ার উপক্রম হইল।

বৈঠকে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলিল। কোনো সিদ্ধান্ত হইল না। একপর্যায়ে শেরেবাংলা বলিলেন, আমি আর বলিতে পারিতেছি না। কোমর ধরিয়া আসিতেছে। পেটেরও কিঞ্চিৎ গোলযোগ। মোরগের আস্ত দুইটি মোসল্লাম, একটি বড় ইলিশ ভাজা এবং ভীমনাগের দেড় কেজি সন্দেশ খাইয়াছি। আমি উঠিলাম।

খাজা নাজিমুদ্দিন বলিলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার এই শোচনীয় অবস্থায় কী করা যায়?

একজন মন্ত্রী বলিলেন, শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আমরা শুধু সাবেক নহি-স্বর্গবাসী। কিছুই করিবার নাই। কোনো পরামর্শ দিলে তাহা পত্রপাঠ অগ্রাহ্য হইবে। আজ যদি সাবেক না হইতাম, স্বর্গবাসী না হইয়া যদি শিক্ষামন্ত্রী থাকিতাম, তাহা হইলে জাতির সর্বনাশ করার দায় মস্তকে ধারণ করিয়া পদত্যাগ করিতাম।

শেরেবাংলা উঠিয়া দ্রুত বাথরুমের দিকে যাইতে যাইতে বলিলেন, উত্তম প্রস্তাব।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক