শিক্ষার উল্টোযাত্রা

প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব হলো না। বরং আগাম ঘোষণা দিয়ে ফাঁস করা হয়েছে কিছু প্রশ্ন। শিক্ষাসচিব মহোদয় এবারের মতো অপারগতা স্বীকার করে নিয়েছেন। দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে, আশা করা যায় এই কমিটি আগামী দিনে সুষ্ঠু পরীক্ষার পথ বাতলে দেবে।
তবে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এ বছরের নতুন উৎপাত নয়, বহুদিন ধরেই এটা হচ্ছে। কখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে, বেশির ভাগ সময় অস্বীকৃতির মাধ্যমে গা বাঁচিয়েছে। আদতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ব্যর্থতা আকস্মিক ব্যাপার নয়, শিক্ষায় অনেক অর্জনের মধ্যেও ব্যর্থতার একটা ধারাবাহিকতা আছে। একসময় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নোট বই-গাইড বই বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু এগুলো বন্ধ হয়নি। কোচিং সেন্টার ও টিউটোরিয়াল বাণিজ্যকে বেআইনি ঘোষণা সত্ত্বেও এগুলো দিব্যি চলছে। আমাদের পাবলিক পরীক্ষায় একসময় দেদার নকল হতো, একমাত্র সেটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এবং তার কৃতিত্ব গত জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনকে দিতে হবে।
আমরা ভুলব না, বর্তমান আমলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে শিক্ষায় অনেক যুগান্তকারী কাজ হয়েছে। প্রায় শতভাগ শিশু প্রাথমিকে ভর্তি হচ্ছে, প্রতিবছর সব স্কুলে ছাত্রকে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করা হচ্ছে, যা বছর বছর বাড়তে বাড়তে এ বছর ৩৬ কোটি বইয়ে দাঁড়িয়েছে। বইয়ের টেক্সট ও ছাপা-বাঁধাই উন্নত হচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষা আশাব্যঞ্জক হারে বেড়েছে, তার জন্য গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর জন্য সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়
সাধুবাদ পাবে। কিন্তু এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মানসম্পন্ন শিক্ষার শর্ত পূরণ আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য যেমন
সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, তেমনি চাই প্রয়োজনীয় অর্থায়ন। শিক্ষার লক্ষ্য সঠিকভাবে নির্ধারিত হলে মানোন্নয়নের জন্য করণীয় নির্ধারণ সহজ হবে।
সেই সঙ্গে আমাদের দেশীয় বাস্তবতা বিবেচনায়
রাখতে হবে।
আমার ধারণা, এসব ব্যাপারে বিভ্রান্তি থাকার কারণে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে ঘন ঘন পরিবর্তন, বিভিন্ন পরীক্ষামূলক সংস্কার করতে গিয়ে অকারণ জটিলতা ও ভোগান্তি বেড়েছে। এর ফলাফল হিসেবে শিক্ষায় এক বিপরীত বাস্তবতা তৈরি হয়েছে—আজ পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোট-গাইড বইয়ের গুরুত্ব বেশি, স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার মূল্যবান, শিক্ষাকে ছাপিয়ে পরীক্ষাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষক মূল্য হারিয়েছেন টিউটরদের কাছে আর এই উল্টোযাত্রার চূড়ান্ত ফল হলো, শিক্ষার্থীরা সবাই শুরু থেকেই পরীক্ষার্থীতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার অভিযাত্রার এই পরিণতি নিয়ে একটু সিরিয়াসলি ভাবা দরকার। নয়তো সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো নতুন নতুন সমস্যার জটে হাবুডুবু খেতে থাকব।
এক বাঙালি মনীষী শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা করে লিখেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য আসলে সবারই জানা, কিন্তু ‘সেটা প্রকাশ করিয়া বলিতে আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর লজ্জিত হই। কেননা উত্তরটা অতি সাধারণ রকমের, এবং বড় কথা বলিয়া ও শুনিয়া যে আত্মপ্রসাদ লাভ করি—সোজা কথা বলায় ও শোনায় আমরা সে সুখে বঞ্চিত হই।’ তারপর তিনি সেই সবার জানা সহজ কথাটা বলেছেন, ‘কথাটা এই যে শিক্ষার উদ্দেশ্য বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া, যাকে আমরা বাংলা কথায় বলি লেখাপড়া শেখানো।’ লেখাপড়া একবার শিখলে এবং তাতে আনন্দ পেলে মানুষটার এই অভ্যাস আজীবন বজায় থাকে। ফলে অব্যাহত শিক্ষা বা জীবনব্যাপী শিক্ষা নামের নানা প্রকল্পের প্রহসনের প্রয়োজন পড়ে না যদি ছেলেমেয়েরা ঠিকভাবে লিখতে-পড়তে শেখে এবং তা থেকে আনন্দের খোরাক পেতে থাকে।
নীতি শিক্ষা ও চরিত্র গঠন নিয়ে বাঙালি বড়ই ভাবিত। পরিষ্কার বলা দরকার, পড়াশোনা চরিত্র গঠনে তখনই সহায়ক হবে, যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ব্যক্তি (শিক্ষক) এবং কার্যক্রম (পাঠ ও সহপাঠ) এই চাহিদার সঙ্গে মানানসই দৃষ্টান্ত ও অনুকূল পরিবেশ রচনা করবে। পরিবার ও সমাজে ব্যক্তিবর্গকে চরিত্র বা নীতিভ্রষ্ট হওয়ার যথেচ্ছ অধিকার দিয়ে রাখলেও সচ্চরিত্রের মানুষ তৈরি করা কঠিন। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থা সেখানে বাদ সেধেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর একমাত্র করণীয়, তাদের জন্য শিক্ষা কর্তৃপক্ষ, সমাজ (এবং গণমাধ্যম) স্বীকৃত সাফল্যের একমাত্র ক্ষেত্র পরীক্ষা, তাদের ছাত্রজীবন ঘন ঘন পরীক্ষা ও নিরবচ্ছিন্ন পরীক্ষা-প্রস্তুতিতেই কেটে যায়। এতে তারা সর্বক্ষণ প্রতিযোগিতার ও সাফল্যের চাপে জর্জরিত থাকে। এমন চ্যালেঞ্জের চাপে যে কচি জীবনটি কাটে, তাতে মানবিক গুণ ও সুকুমারবৃত্তির মতো যেসব গুণাবলি—জীবনযাপন, অনুশীলন ও উপভোগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে অর্জনযোগ্য—সেগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থেকে যায়।
বিদ্যালয় ও পরিবার তাদের এ কাজে সহায়তা দিতে পারে না, বরং তারা শিশুদের ইঁদুর দৌড়ে অন্যদের পেছনে ফেলার জন্য বাড়তি চাপ দেয়, নিজেরাও বাড়তি কিছু করে দেখাতে চায়। এই বাড়তি কাজের সর্বশেষটি হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস। নিশ্চিতভাবেই এর লগ্নিকারী প্রযোজক অভিভাবকবৃন্দ এবং এই দুর্নীতির জাল বিস্তৃত হতে হতে এতে জড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকসহ শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরের লোকজন মায় ছাত্ররাও। তবে কচি ছাত্রগুলো যে এখনো বিবেক ও সংবেদনশীলতা হারায়নি, তা বোঝা যায় প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে ধৃত ছাত্রদের মুখ ঢাকার চেষ্টা বা লজ্জিত মুখাবয়ব দেখে। তারা তো দোষী নয়, বড়দের
সমবেত অবিমৃশ্যকারিতা ও ব্যর্থতার শিকার (victim)। তাদের অভিযুক্ত করে সমাজ বা শিক্ষাকর্তারা কি নিজেদের দায় ও লজ্জা ঢাকতে পারবেন?। সব মিলে বলা যায়, এটাই আমাদের শিক্ষার উল্টোযাত্রার চূড়ান্ত ফল।
এই যাত্রায় যদি কেবল প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের উপায় বের করার মধ্যেই সমস্যার সমাধান খুঁজি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে পরীক্ষার ফলের পেছনে ছুটন্ত অভিভাবক-শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের
প্রাণান্ত প্রয়াস অচিরেই বিকল্প পথের সন্ধানে ব্যয়িত হবে। তাতে শিক্ষার লক্ষ্যভ্রষ্ট যাত্রায় পুরোনোর সঙ্গে নতুন রোগের উপসর্গ যোগ হয়ে মাথাব্যথার কারণ বাড়বে বৈ কমবে না। এই উল্টোযাত্রায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি বোধ হয় এই হয়েছে যে শিক্ষায় শিক্ষকই খলনায়ক রূপে চিহ্নিত হচ্ছেন, অন্তত শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের কথায় তা-ই মনে হয়। কিন্তু শিক্ষায় মূল চরিত্র হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থীকে বলব মূল পাত্র। ব্যবস্থার ‘গুণে’ কিছু শিক্ষক নিশ্চয় দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন, কিন্তু তাই বলে শিক্ষার মূল চরিত্রকে ভিলেন বানিয়ে অভিযুক্ত করে কীভাবে শিক্ষার
রোগ সারাব?
আমাদের স্কুলশিক্ষার মূল দুর্বলতাই হলো আদর্শবান মেধাবী তরুণদের এ পেশায় আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। অধিকাংশের অনিচ্ছার পেশা এটি, আগ্রহের ঘাটতি থাকলে নিজেকে তৈরি করা ও কাজে আন্তরিকতার ঘাটতি থাকবেই। প্রশিক্ষণ বা আর্থিক প্রণোদনাকে ছাপিয়ে তাঁদের আগ্রহ প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং সেন্টারে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং খাবে। পরীক্ষামুখী এই ব্যবস্থা তাঁদের শিক্ষা–বাণিজ্যের চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছে, স্কুল হলো ছাত্র ধরার মৃগয়াক্ষেত্র। এই ব্যবসায় মূল পুঁজি হলো ছাত্রের ফলাফলের ভিত্তিতে অর্জিত ‘গুডউইল’। এভাবে ছাত্ররা বাণিজ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আর সব মিলে নীতিনির্ধারক, কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক এবং অভিভাবক ও ছাত্রদের যোগসাজশে আমাদের
শিক্ষার উল্টোযাত্রা সব দুর্নীতি ও ব্যাধি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিনা মূল্যে বই, বইয়ের মান বৃদ্ধি, সৃজনশীল প্রশ্ন—সবই এই ব্যবস্থার জ্বালানি হিসেবে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো শিক্ষাব্যবস্থার রোগের বাড়াবাড়ি অবস্থা, যাকে বলে যাই যাই অবস্থা। তাই এর জন্য অবিলম্বে কার্যকর কড়া ডোজের ওষুধ দিতে হবে হয়তো র‍্যাব-পুলিশের তৎপরতাসহ। কিন্তু এতে রোগের সাময়িক উপশম হবে, সেই ফাঁকে এইচএসসি পরীক্ষাটাও পার করতে পারলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। তবে বেশি কালক্ষেপণ না করে আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। শিক্ষানাট্যের মূল চরিত্রকে উপেক্ষা করে, তাঁদের নষ্ট পথে ঠেলে দিয়ে ও রেখে এবং বিষয়কে (শিক্ষা) বিকৃত করে (পরীক্ষায় বন্দী করে) এই নাটকের মিলনান্তক সমাপ্তি আশা করা যায় না। বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং দুই শিক্ষামন্ত্রী—চারজন মিলে (চতুরানন হলেন ব্রহ্মা) ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে শিক্ষার উল্টোযাত্রা বন্ধ করে তার অগ্রযাত্রার পথ সুগম করবেন।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক