ব্যান্ডের গান ও গণতন্ত্রের 'নীল মার্সিডিজ'

নব্বইয়ের দশকে দেশে ব্যান্ড সংগীতে আসে জোয়ার
নব্বইয়ের দশকে দেশে ব্যান্ড সংগীতে আসে জোয়ার

‘চোখের ইশারায় ছুড়ে দেব সুতীক্ষ্ণ চুম্বন

তুমি দিশেহারা হয়ে যাবে

তুমি পথহারা হয়ে যাবে’

ব্যান্ড সংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী জেমসের গানটি বাংলাদেশি সমাজে ভালোবাসা জানান দেওয়ার নতুন এক ভাষার সূচনা করে, যেখানে ভালোবাসার এক বোহেমিয়ান জাদুকরি প্রভাব নব্বইয়ের তরুণসমাজকে উদ্বেলিত করেছিল। আমার মতো ভক্তকুলের চোখে জেমস ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের রহস্যময় পুরুষ ‘হিমুর’ মতো। এ কথা মানতেই হবে যে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক ছিল অনেকটা অলিখিত রেনেসঁার মতো; যেখানে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য ও নাটক, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও হেলাল হাফিজের কবিতা আর জেমসের নগর বাউলের মতো ব্যান্ড এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটা নীরব বিপ্লবের মতো ঘটিয়েছিল।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ওই সময়ের সাহিত্য, নাটক ও কবিতা নিয়ে যতটুকু লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে, সে তুলনায় ব্যান্ড সংগীত নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। আমাদের গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের কাছে এ ধরনের সংগীত থেকে গেছে অচ্ছুতের মতো আর গণমাধ্যমের চোখ থেকে ব্যান্ড সংগীতের শিল্পীদের ‘তারকা’র চোখধঁাধানো কাঠামো থেকে বের করা যায়নি। অথচ আমাদের দেশের ব্যান্ডের শিল্পীরা তাঁদের গানের মাধ্যমে এক নীরব সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন, যে বিপ্লব প্রেমের পাশাপাশি বলে এসেছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, দেশপ্রেমের কথা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের কথা, অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশের কথা।

আমরা জানি যে বিশ্বজুড়ে নানা রকম গোঁড়ামিকে চ্যালেঞ্জ করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে সংগীতের ভূমিকা ঐতিহাসিক। বিশেষ করে ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণবাদের বৈষম্য ঘোচানোর ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের যে আন্দোলন, সেই বিখ্যাত ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’-এর ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি বিশ্বব্যাপী এখনো অনেক জনপ্রিয়। এ ছাড়া সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী সংগীতশিল্পী বব ডিলান, ব্রিটিশ ব্যান্ড পিঙ্ক ফ্লয়েড, আইরিশ ব্যান্ড ইউ টু, মার্কিন হিপহপ সংগীতশিল্পী টুপ্যাক শাকুরের যুদ্ধবিরোধী ও সামাজিক বৈষম্যবিরোধী নানা রকম গান সমাজ পরিবর্তনে বিস্ময়কর ভূমিকা রেখেছে। এদের নিয়ে লেখা হয়েছে বিস্তর গবেষণাপত্র এবং প্রকাশিত হয়েছে বহু বই।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও সংগীতের ভূমিকা অপরিসীম। শুনেছি এবং ইতিহাস পড়ে জেনেছি, যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত ‘মোরা একটি ফুলকে বঁাচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানগুলো আমাদের বীর মুক্তিসেনাদের আরও উজ্জীবিত করত দেশ স্বাধীন করতে। যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের হাত ধরেই শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন ধারার সংগীত, যা এখন ব্যান্ড সংগীত নামেই পরিচিত। আজম খানের পর নব্বইয়ের দশকে পুঁজিবাদের বাজার বিস্তার এবং স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে ব্যান্ড সংগীতে আসে এক নতুন জোয়ার। দেশের তরুণসমাজের এক বিরাট অংশের চোখে সমাজে মূল্যবোধ পরিবর্তনের তারকা হিসেবে উঠে আসেন মাকসুদ, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, ওয়ারফেজ, রকস্ট্রাটা, ফিডব্যাক, নোভা, প্রমিথিউস, অর্থহীনসহ অনেক ব্যান্ড ও সংগীতশিল্পী। সমাজ সম্পর্কে কী রকম ছিল এসব ব্যান্ড দলের চিন্তাভাবনা?

উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায় ওয়ারফেজ ব্যান্ডের ১৯৯৮ সালের ‘ধূসর মানচিত্র’ নামের এক গানের কিছু কথা, যেখানে ব্যান্ডটি দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের স্বরূপ দেখিয়েছিল এভাবে:

‘এ এক দুঃসময় যখন দেখি সারা পথজুড়ে

নিত্য মৃত, জীর্ণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস উড়ে বাতাসে

আর রাজপথ ভেঙে ছুটে চলে নীল মার্সিডিজ

উদ্যম বৈভবে গণতন্ত্র যার মাঝে বসে

চোখ মারে আর হাসে।’

গণতন্ত্রের নামে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতার (সবাই নন) রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যে হাহাকার, তা-ই উঠে এসেছিল ১৯৯৮ সালে ওয়ারফেজের গানটিতে; কিন্তু তেমন গুরুত্ব পায়নি আমাদের গণমাধ্যম, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের কাছে। আর সেখানেই সংঘটিত হয়েছে এক ঐতিহাসিক ভুল, যার ফল এখন আমরা দেখছি ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণু সামাজিক সংস্কৃতিতে এবং এক সুবিধাবাদী রাজনীতির শিকল, যা গণমানুষের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের কথা কমই বলে।

 গণতন্ত্র মানে আসলে কী? আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষের কাছে এটা হয় নির্বাচন অথবা উন্নয়ন কিংবা নির্বাচন ও উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক থেকে গণতন্ত্রের মানে অনেকটা সাংস্কৃতিক। এই সংস্কৃতিতে আছে কথা বলার স্বাধীনতার সংস্কৃতি, নিজের অধিকার রক্ষার সংস্কৃতি, গরিবের দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা ‘গণতন্ত্রের নীল মার্সিডিজে’ বসে থাকা রাজনীতিবিদদের গরিবের কাছে জবাবদিহির সংস্কৃতি, ভিন্নমতকে সম্মান করা, অর্থাৎ মুক্তমনের সংস্কৃতি ইত্যাদি। যেকোনো সংস্কৃতি একটা সামাজিক অভ্যাস হিসেবে ব্যাপক চর্চার মধ্যে সংস্কৃতিতে রূপ নেয় এবং এ জন্য দরকার হয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু ব্যান্ড সংগীত আমাদের দেশে একটা ‘অনাহূত আগন্তুকের’ মতোই থেকে গেল। একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই সংস্কৃতির খোঁজ পাওয়া যাবে না বাংলাদেশ নিয়ে লেখা কোনো ইতিহাস বা সমাজবিজ্ঞানের বইয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো গবেষণায়। ব্যান্ড সংগীত কেমন যেন অচ্ছুতের মতো—এটাকে ব্যবহার করা যাবে কিন্তু স্বীকৃতি জানানো যাবে না—এই মনোভাব প্রকারান্তরে ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের।

কারণ আগেই বলেছি, এই ব্যান্ডগুলো শুধু প্রেম-ভালোবাসার গানই করেনি; বছরের পর বছর ধরে তাদের গানে উঠে এসেছে গণতন্ত্রের নামে অর্থনৈতিক লুটেরাদের সামাজিক চোটপাট (‘গণতন্ত্র মানে মুক্তবাজারের দগ্ধ আগুন আর শেয়ারবাজার লুটেরা কোটিপতি বেড়েছে কতশত গুণ, তাই গণতন্ত্র মানে মধ্যবিত্তের হয়ে যাওয়া অন্ধ’,—মাকসুদ ও ঢাকা), স্বৈরাচারের সঙ্গে ওঠবস (‘গণতন্ত্র মানে বিশ্ববেহায়া মুক্ত বাতাসে কবিতা লেখে আর দেশপ্রেমিক জনতা নব্বইয়ের ইতিহাস ভুলেই গেছে’—মাকসুদ ও ঢাকা), গণতন্ত্রের নামে রাজপথে শহীদ হয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর কথা (‘গণতন্ত্র মানে কিছু বোকার মিছে শহীদ হওয়া, আজ কাকের হাগায় তাদের স্মৃতিসৌধ ছাওয়া’—মাকসুদ ও ঢাকা), উগ্রবাদের সমালোচনা (‘কোন পথে আমরা চলছি হায় পরওয়ারদিগার, তোমার অস্তিত্ব স্বীকার করি আমরা যে গুনাহগার, ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের নাম দিলাম মৌলবাদ, পাল্টে জবাব ওরা দিল আমাদের “তোরা নাস্তিক মুরতাদ”’—মাকসুদ ও ঢাকা) এবং সর্বোপরি আমজনতার ক্ষমতাহীন হয়ে থাকার কথা (‘এক রাজ, আর গণতন্ত্র মিশে একাকার, আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত দাও’—অর্থহীন ব্যান্ড)। কিন্তু এত মেধাবী মাধ্যম হওয়ার পরও এই সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে উপেক্ষা করার সংস্কৃতি প্রকারান্তরে ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের।

ব্যাপারটার পেছনে কিছুটা রাজনীতিও জড়িত। কারণ, আমরা যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করেছি, সেখানে নেই ব্যান্ড সংগীত। কারণ নিন্দুকের মতে, তারা হচ্ছে ‘অপসংস্কৃতি’ বা ‘বাজে ছেলেদের’ সংগীত। আরও নানা রকম সামাজিক কারণও আছে, যেমন নব্বই অথবা এর পরের দশকের সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক গবেষক—যঁাদের অনেকেই আমার শিক্ষক ও সাংবাদিক, লেখক—তঁারা তরুণদের এই সংগীত বুঝতে পারেননি বা চাননি। এটা ছিল অনেকটা ইচ্ছা করে নাক সিটকিয়ে থাকার মতো ব্যাপার। কারণ, যঁারা ব্যান্ড সংগীতের আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তঁাদের অনেকেই হয়তোবা একটা বঁাধাধরা নিয়মে জীবন যাপন করেননি। কারও কারও ব্যক্তিগত উদ্দামতা, জীবনযাপনের ধরনও দূরে ঠেলে দিয়েছে আমাদের নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের। কিন্তু শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন ও তঁার শিল্প বা তঁার সৃষ্টি যে আলাদা হতে পারে, তা অনেকেই মানতে চাননি, বুঝতে চাননি। ফলে আজম খানের শুরু করা এই সংগীত আন্দোলন কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

কিন্তু বোঝা দরকার, উগ্রবাদের এই যুগে ব্যান্ড সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকারি। মনে রাখতে হবে যে গণতন্ত্রহীনতা ও জঙ্গিবাদ যেমন একধরনের সংস্কৃতি, তেমনি গণতন্ত্র ও সহিষ্ণুতাও একধরনের সংস্কৃতি। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু এবং নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে—যে সংস্কৃতি গণমানুষের কাছে পৌঁছায়, যে সংস্কৃতি উদারতার কথা বলে, সেই সংস্কৃতিকে প্রণোদনা দেওয়া, উপেক্ষা না করা। ব্যান্ড সংগীতের এই শক্তিটাকে রাষ্ট্রের ও সমাজের নীতিনির্ধারকদের বোঝা দরকার—মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করার লক্ষ্যে।

ড. মোবাশ্বার হাসান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক