মালদ্বীপে ভারত যা করতে পারে

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন। ছবি: রয়টার্স
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন। ছবি: রয়টার্স

মালদ্বীপ। ভারত মহাসাগরে হাজারের বেশি কোরাল দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নয়নাভিরাম দেশ। বিশ্ব পর্যটকদের এক নিরিবিলি ও বিলাসবহুল গন্তব্য। সেই শান্ত-সুন্দর দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতায় এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে আন্তর্জাতিক পরামর্শকেরা পর্যন্ত সেখানে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করছেন।

এ মাসের শুরুতে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ নয়জন বিরোধী নেতার সাজার আদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়ার পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন তাঁদের ছেড়ে না দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ দুজন বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করেন।

এ কথা ঠিক যে মালদ্বীপে কর্তৃত্ববাদী সরকার নতুন নয়। ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত নাশিদই একমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাঁর ক্ষমতাকাল মাত্র তিন বছর টিকেছিল। ২০১২ সালে তাঁকে বন্দুকের নলের মুখে গদি ছাড়তে হয়। ভারত মহাসাগরের শিপিং লেনে অবস্থানের কারণে মালদ্বীপ নিরাপত্তার দিক থেকে এই অঞ্চলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এখানকার সংকটকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ভারত মহাসাগরে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে একদিকে চীন ইয়ামিন সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশ জাতিসংঘকে মালদ্বীপে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানাচ্ছে।

একসময় এই অঞ্চলে ভারতই মালদ্বীপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। কিন্তু সেখান থেকে সরে গিয়ে দেশটি চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। মালদ্বীপের অধিবাসীরা মূলত ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত। এই দেশকে বহু আগে থেকেই ভারতীয় প্রভাববলয়ের অংশ বলে ভাবা হয়ে থাকে।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব অনেকখানি কমিয়ে এনেছে চীন। চীন ভারত মহাসাগরে সামরিক শক্তি মোতায়েন ও অর্থনৈতিক প্রকল্প গড়ার মধ্য দিয়ে যে ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ নামক প্রভাবপ্রাচীর গড়ে তুলছে, সেটি ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। চীন অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। এ ছাড়া নাশিদের বক্তব্য অনুযায়ী, মালদ্বীপের ১৭টি দ্বীপে বিনিয়োগ করে প্রকারান্তরে সেগুলোর মালিক হয়ে গেছে চীন। আঞ্চলিক কৌশলগত সীমারেখা লঙ্ঘন করে চীন মালদ্বীপে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। এভাবে মালদ্বীপকে নিজের নৌঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে চীন ভারতের ওপর সামরিক চাপ প্রয়োগ করছে।

ফলে মালদ্বীপের এই সংকটকে কীভাবে নেওয়া যেতে পারে, সেই প্রশ্ন এখন ভারতের সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। নাশিদ ও অন্যান্য বিরোধী নেতার অনুরোধ মেনে ভারতের কি মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ করা উচিত? নাকি ইয়ামিনকে থাকতে দিয়ে সেখানে চীনের প্রভাব বাড়ানোকে মেনে নেওয়া উচিত? ১৯৮৮ সালে শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা নিয়ে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মালদ্বীপের একজন ব্যবসায়ী তৎকালীন মামুন আবদুল গাইয়ুমকে সরাতে চেয়েছিলেন। ভারত সেই অভ্যুত্থানচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছিল।

২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নাশিদের কার্যালয় ইসলামপন্থীরা ঘিরে ফেললে নাশিদ তখন ভারতের সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারত তখন তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। কারণ, চীনের সঙ্গে নাশিদ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলায় ভারত প্রতারিত বোধ করেছিল। নাশিদের পতনের মাত্র তিন মাস আগে একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে গিয়েছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তাঁর সফরের সময়ই নাশিদ মালেতে চীনের নতুন দূতাবাসের উদ্বোধন করেন।

এই মুহূর্তে মালদ্বীপে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ, কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ এখনো তাকে সেখানে হস্তক্ষেপের জন্য ডাকেনি। ভারতীয় ছত্রীসেনারা চাইলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মালে দখল করে ফেলতে পারে। কিন্তু তারপর? সেখানকার ইসলামপন্থীদের সহায়তায় যদি তৃতীয় কোনো শক্তি আসে, সেটি সামাল দেওয়া কিছুটা দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি ইয়ামিনের যদি পতন হয় এবং দেশটিতে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়, তাহলেও মালদ্বীপে চীনের প্রভাব কমবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তারে যেভাবে চীন কূটনৈতিকভাবে ভারতকে পেছনে ফেলেছে, মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। নির্বাচনে নাশিদ এলেও যেহেতু দেশটি চীনের কাছে দেনায় ডুবে আছে, সেহেতু তার পক্ষে চীনের কবল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।

এর বদলে ভারত যদি এখন ইয়ামিন সরকারকে সামরিক অভিযানের বিশ্বাসযোগ্য হুমকির মধ্যে রাখে, অন্য গণতান্ত্রিক সরকারকে সঙ্গে নিয়ে তার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে এবং মালদ্বীপের সম্ভ্রান্ত শ্রেণিকে ইয়ামিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উদ্দীপ্ত করে, তাহলে সেটাই সঠিক কাজ হবে। এ বছরের শেষে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন দেওয়ায় ইয়ামিনকে বাধ্য করাই হবে ভারতের সবচেয়ে যৌক্তিক পদক্ষেপ।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডেকট

ব্রহ্মা চেলানি: নিউ দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক