এই আফ্রিকান মাগুর আটকাতেই হবে!

প্রশ্নফাঁসের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এ পর্যন্ত এসএসসির ১১টি আবশ্যিক পরীক্ষা কলঙ্কিত করেছে। গত সোমবার ছিল জীববিজ্ঞান পরীক্ষা। সেটাতেও বনবিড়ালের কঠিন থাবা বসিয়েছে প্রশ্নফাঁস। এই বনবিড়ালের গলায় ফাঁস লাগতে যাঁরা আদাজল খেয়ে নেমেছেন, হয়রান-পেরেশানে তাঁদের অবস্থা বড্ড কাহিল। ধরপাকড় কিন্তু কম হচ্ছে না, তবে মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

প্রশ্নফাঁসের বিষয়টাকে বনবিড়াল বলার কারণ আছে। চতুর এই চতুষ্পদ প্রাণীর উপদ্রব যে কেমন, তা ভুক্তভোগী গৃহস্থেরা হাড়ে হাড়ে টের পান। হাঁস-মুরগির দঙ্গলে বনবিড়াল এমনভাবে হানা দেয়, বেশির ভাগ সময় করার কিছু থাকে না। গৃহস্থ ফাঁদ পাতেন এক জায়গায়, নিশাচর ওই ছ্যাঁচড় অপকর্ম সারে আরেক জায়গা দিয়ে। মাঝখান থেকে বাড়িসুদ্ধ মানুষের ঘুম হারাম।

প্রশ্নফাঁস হওয়ার ব্যাপারটিও এখন তেমন পর্যায়ে। আমরা শুনছি, দেখছি, জানছি, বুঝতে পারছি সবই, কিন্তু ঠেকানো যাচ্ছে না। আন্তমন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে প্রশ্নফাঁস হওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কাছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য চেয়েছে। এই তৎপরতার জন্য সরকার বাহাদুরকে ধন্যবাদ। সরকার বাহাদুরকে আরেকটা বড় ধন্যবাদ জানাতে হয় প্রশ্নফাঁস ঠেকানোর কৌশল হিসেবে ইন্টারনেটে হস্তক্ষেপের মতো কোনো সিদ্ধান্তে না যাওয়ায়। এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে ইন্টারনেট আড়াই ঘণ্টা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা অবশ্যই সুমতি।

একটু উদাহরণ দিই। উবারের গাড়িতে করে অফিসে পৌঁছে পড়ে গিয়েছিলাম বিপদে। সেদিন সকালে ইন্টারনেট সংযোগে বিভ্রাট ঘটায় চালকের মোবাইল ফোনে ভাড়ার অঙ্ক আর ওঠে না। তিনিও ভাড়া চাইতে পারেন না, আমিও দিই কী করে? শেষে উবার ডাকার আগে মোবাইলে যে ভাড়া দেখেছি, সেটা জানালাম। চালক নেহাত ভদ্রলোক। মেনে নিলেন। না মানলে কী হতো?

সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে ডালপালা নিয়ে টানাটানি করে কোনো লাভ নেই। আমাদের শিক্ষাঙ্গন কোনোকালেই দুর্নীতি বা অপরাধমুক্ত ছিল না।

এসএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় একেবারেই নকল হবে না—এমনটি আশা করা যায় না। কারণ, কিছু শিক্ষার্থী নকল করে পরীক্ষা দেওয়ার খায়েশ নিয়েই তৈরি হয়। এতে তারা খুব যে লাভবান হয়, তা নয়। কেউ ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হয়, কারও-বা জোটে নামের পাস। তবে মেধাবীরা সব সময়ই যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখে। কিন্তু প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি আজ মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। ভয়টা এখানেই।

এটা আসলে উন্নত প্রযুক্তির অপব্যবহার। ইন্টারনেট, অ্যাপস আর স্মার্টফোন বা ট্যাব হচ্ছে প্রশ্নফাঁস করার অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গ। যুগের হাওয়া বুঝে প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে অসদুপায় অবলম্বনকারীরা।

অন্যভাবে বলা যায়, প্রযুক্তির উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে চলছে অপরাধমূলক কাজ। এ অপরাধে কেবল নির্দিষ্ট পক্ষ বা শ্রেণির লোক জড়িত নন, এতে যেমন একশ্রেণির অসাধু সরকারি কর্মচারী জড়িত, তেমনি আছেন স্খলিত চরিত্রের একশ্রেণির শিক্ষক, হুজুগে গা-ভাসানো একশ্রেণির শিক্ষার্থী, এমনকি কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিভাবকও।

২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে ‘ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনতে তহবিল’ শীর্ষক খবর। আর এই তহবিল গঠন করেছেন অভিভাবকেরা। ভাবা যায়!

আমাদের দেশে গড়পড়তা অভিভাবক স্বপ্ন দেখেন, সন্তান পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে। ভালো চাকরি নিয়ে স্বচ্ছন্দে খেয়েপরে বাঁচবে। আর গড়পড়তা মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন থাকে ভালো ফল নিয়ে পাস করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ কিংবা মজবুত ক্যারিয়ার গড়ার মতো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া।

এসব লক্ষ্যে অটল থেকে অনেক শিক্ষার্থীই আড়মোড়া ভেঙে পড়াশোনা করে। কিন্তু তারা যখন দেখে, এত খাটাখাটনি করে তারা যে ফলটা পাচ্ছে, পড়াশোনা না করা শিক্ষার্থীরা ফাঁস করা প্রশ্ন ঘেঁটে একরকম বিনা শ্রমেই একই ফল করছে, তখন মানসিক আর নৈতিকভাবে তাদের হতাশ হওয়াটা স্বাভাবিক।

প্রশ্নফাঁসেই যদি মোক্ষলাভ, তবে আর কষ্ট করে বিদ্যার্জন কেন? ওখানেই বিনিয়োগ হোক, এই ভেবে বিচ্যুত কিছু অভিভাবকও নীতি-নৈতিকতার গুলি মেরে চাইছেন নগদ লাভ। ‘প্রশ্নফাঁস-বাণিজ্য’ এর মধ্যে কিছু তরুণের ‘মৌসুমি ব্যবসা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহানগর পুলিশের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, এসব তরুণের মধ্যে অনেকেই শিক্ষার্থী। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার সময় তাঁরা কয়েকজন একজোট হয়ে বাণিজ্য করে থাকেন।

এভাবে প্রশ্নফাঁস যদি অবাধে হতেই থাকে, তবে তা একসময় শিক্ষার্থীদের পড়ার পাট সত্যিকার অর্থেই শিকেয় তুলবে। শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের কাছে তখন মূল লক্ষ্য হবে কত সহজে, কত কম সময়ে, কত নির্ভুল প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। তখন আরও রমরমা হবে ‘প্রশ্নফাঁস-বাণিজ্য’।

ফলটা কী দাঁড়াবে? কয়েক বছরেই এই সোনার দেশ মেধাশূন্য এমন প্রজন্ম পাবে, যারা সংসারের শোভাবর্ধন আর শ্রমবাজারের চাহিদাপূরণ ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগবে না। এসব ছেলেমেয়ের নৈতিক মনোবল আর আত্মবিশ্বাস বলে কিছু থাকবে না। থাকবে না সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা। বাইরের দুনিয়ায় গিয়ে তারা বিদ্যাবুদ্ধির শক্ত ভিত খুঁজে পাবে না। জেনেশুনে এই বিষ কি আমরা পান করতে পারি? সজ্ঞানে স্বজাতির এই সাড়ে সর্বনাশ কি চাই?

উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। আপনার কাছেই থাক।

আমরা বড়ই আবেগপ্রবণ জাতি। নতুনকে যেমন সাদরে গ্রহণ করতে আমাদের জুড়ি নেই, তেমনি বর্জনেও আমরা নির্মম! এই গ্রহণ আর বর্জন দিয়েই কিন্তু আমরা অনেক অসাধ্যসাধন করতে পারি। অনেক জটিল সমস্যায়ও তা সহজেই কাজে লাগতে পারে। প্রয়োজন কেবল সম্মিলিত ইচ্ছাটা।

সত্তরের দশকে স্বাধীনতার পরপরই এ দেশে ‘বেলবটম’ বলে একধরনের প্যান্টের প্রচলন ঘটে। বিশেষ করে তরুণ-যুবারা এই প্যান্ট বানাতেন। প্যান্টের নিচের দিকটা হতো বেল বা ঘণ্টাকৃতির। এটাই বেলবটম। নিচে কে কত ঢোলা দিতে পারে, এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো। অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না প্রমুখের সত্তরের দশকের কিছু হিন্দি ছবিতে এসব প্যান্ট দেখা যায়। ওই সময়ের বাংলা ছবির নায়কেরাও এসব প্যান্ট পরেছেন।

আর শার্টের কলার করা হতো গোলাকার। তা ছিল অনেকটা কুকুরের জিবের মতো। পাড়া বা মহল্লার দরজির দোকানে গিয়ে খুব জোশ করে বলা হতো, ‘ওই মিয়া, কলারটা কিন্তু কুত্তার জিব হইব!’ এসব শার্ট আর প্যান্টে গোটা দেশ ছিল সয়লাব।

ওই সময় এখনকার প্যান্ট ছিল বেমানান। অবজ্ঞা করে বলা হতো ‘চোঙা প্যান্ট’। কিন্তু এই ফ্যাশন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সেই চোঙা প্যান্টই আবার ফিরে এসেছে। শার্ট ফিরে পেয়েছে চিরন্তন স্বাভাবিক কলার। কোনো নিষেধাজ্ঞার গ্যাঁড়াকলে আটকে যে এই ফ্যাশন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, তা নয়। চলতি হাওয়ায় গা ভাসালেও আসলে এসব শার্ট-প্যান্টের নকশা সর্বজনীনভাবে সমাদৃত হয়নি। এ দেশের মানুষের সৌন্দর্যবোধ আর সুকুমারবৃত্তির কাছে ওই হাওয়াই ফ্যাশনের পরাজয় ঘটেছে।

নব্বইয়ের দশকে শহর-বন্দর-গ্রামে ইয়া বড় বড় একধরনের মাগুর মাছের কদর খুব বেড়ে যায়। দামে সস্তা নধরকান্তি এসব মাছ দেদার বিক্রি হতে থাকে। আর প্রাণটা কী শক্ত! কাদার মধ্যে ফেলে রাখলেও মরে না। কিন্তু সে হাওয়াও মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি।

মানুষ ঠিকই বুঝে গেছে, এ তো আমাদের শান্ত জলের আদুরে মাগুর নয়। রীতিমতো রাক্ষস! এর মধ্যে ভয়ংকর পরজীবী থাকে। আর এ রাক্ষুসে মাছ পুকুর-বিলের সব প্রাণী খেয়ে সাফ করে দেয়। আফ্রিকান এই দানব মাছ বর্জনে দেশজুড়ে ব্যাপক জনসচেতনতার প্রয়োজন হয়নি। দেশের সব মানুষ নিজ প্রয়োজনে নিজ থেকে বিমুখ হয়েছে। সেই আফ্রিকান মাগুরের এখন দেখা মেলা ভার।

প্রশ্নফাঁসের বনবিড়াল শিগগিরই যে আফ্রিকার মাগুর হয়ে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মাগুর আমাদের আদরের সন্তানদের মেধা-মনন খেয়ে ছোবড়া বানিয়ে দেবে। তারা হয়ে উঠবে সত্যিকারের শিক্ষাবিবর্জিত ভালো ফলসর্বস্ব জড় পদার্থ। কাজেই সচেতন হওয়ার সময় এখনই।

আর একটি মাস পরই এইচএসসি পরীক্ষা। এটাই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ার প্রথম সোপান। আমাদের এখন ব্রত হওয়া উচিত, এই পাবলিক পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নফাঁস আমরা হতে দেব না। প্রশ্নফাঁস হলেও সেদিকে তাকাব না। যে করেই হোক, এই ‘আফ্রিকান মাগুর’কে আমরা আটকাব, তাড়াব। এক কথায়—নির্মম বর্জন!

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]