ত্রিপুরার নির্বাচন যে কারণে মনোযোগ কেড়েছে

ত্রিপুরার নির্বাচনী উৎসবে ভোট দিয়েছেন নব্বই শতাংশ ভোটার।
ত্রিপুরার নির্বাচনী উৎসবে ভোট দিয়েছেন নব্বই শতাংশ ভোটার।

ভৌগোলিকভাবে ত্রিপুরা হলো ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। ৫৪৫ আসনবিশিষ্ট ভারতীয় লোকসভায় ত্রিপুরার জন্য বরাদ্দ মাত্র দুটি আসন। তার মধ্যে আবার একটি ‘শিডিউল ট্রাইব’দের জন্য সংরক্ষিত। এ থেকে অবশ্য ভারতীয় রাজনীতিতে রাজ্যটিকে গুরুত্বহীন ভাবলে ভুল হবে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক সমীকরণে।

ভারতের কেন্দ্রে যারা ক্ষমতায় রয়েছে, সেই সংঘ পরিবার যে তিন শক্তিকে (মুসলমান, খ্রিষ্টান ও কমিউনিস্ট) ভাবাদর্শিকভাবে প্রতিপক্ষ মনে করে, তাদের একটি ৭০ বছর ধরে ত্রিপুরায় প্রায় একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে আছে। বিজেপির জন্য এটা এখন অসহ্য পরিস্থিতি।

১৯৫২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনগুলোর মধ্যে ত্রিপুরার একটি আসনে চারবার এবং অপর আসনে তিনবারমাত্র অ-কমিউনিস্টরা জিতেছে।

স্থানীয় বিধানসভার ইতিহাস আরও বেশি কমিউনিস্ট-প্রভাবিত। ১৯৬৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩টি নির্বাচনে আটবার সিপিএম (মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি) রাজ্যের নির্বাচনে জিতেছে। এর মধ্যে গত ৩৪ বছর তারা একচেটিয়া জিতে চলেছে। সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার ২০ বছর ধরে এই পদে আছেন। এর চেয়েও বড় বিষয় হলো, ৬০ আসনের ত্রিপুরা বিধানসভায় এ পর্যন্ত আরএসএস পরিবারের হিন্দুত্ববাদী কোনো দলের প্রার্থী জেতেননি—অন্তত সর্বশেষ বিধানসভা পর্যন্ত।

এমন বিরূপ অতীতের ওপর দাঁড়িয়ে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেই যেসব রাজ্যে বিজেপি পরিবার বিশেষ সাংগঠনিক মনযোগ দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ত্রিপুরাও। এর কারণটি যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি ছিল আদর্শগত। বিজেপির এরূপ মনোভাব দেখেই দিল্লির প্রচারমাধ্যমগুলো ত্রিপুরার নির্বাচনকে বলছিল ‘ওয়াটারলুর যুদ্ধ’। সেই যুদ্ধের ফল কী দাঁড়াচ্ছে, সেটা জানা যাবে আগামী ৩ মার্চ।

১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শেষ হলো ত্রিপুরার নতুন বিধানসভার ভোট। এবার অবশ্য ভোট হচ্ছে ৫৯টি আসনে। এ মুহূর্তে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমের একটাই প্রশ্ন, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন কি ত্রিপুরায় কাস্তে-হাতুড়ি পতাকা নামিয়ে গেরুয়া পতাকা ওড়াবে?

প্রচারমাধ্যমের এত মনযোগের কারণ, বিজেপি ছোট্ট এই রাজ্যের নির্বাচনকে জীবনমরণ যুদ্ধে পরিণত করে ফেলেছিল। স্বভাবত বামফ্রন্টও তা-ই করেছিল। এরূপ হাড্ডাহাড্ডির তাৎক্ষণিক ফল হয়েছে একটা রেকর্ড। ভোটারদের মধ্যে ৯২ শতাংশ (পোস্টাল ব্যালটসহ) এই নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন এবং এবার নিয়ে তৃতীয়বার ত্রিপুরায় ৯০ শতাংশের বেশি ভোটার টার্ন-আউট হলো, যা ভারতের ইতিহাসে একটা বিরল নজির।

ত্রিপুরায় ভোটারদের বেশি বেশি কেন্দ্রে আসার একটা বড় কারণ হলো, আদিবাসী-বাঙালি সবাই এই রাজ্যে ভীষণ রকমে রাজনীতি-সচেতন। এই সেই রাজ্য, যেখানে বিভিন্ন সময় ছোট-বড় অর্ধডজন সশস্ত্র সংগঠনের সক্রিয়তা ছিল স্বাধীনতার দাবিতে। আবার ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্টদের দুর্দিনেও ত্রিপুরা থেকে সিপিএমকে একটিবারের জন্যও হটানো যায়নি, যেমনটি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে ও কেরালায়। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তৃণমূলের কাছে নির্দয়ভাবে হেরেছে, আর কেরালায় মাঝেমধ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে তাকে।

অতীতে ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট জিতলেও মূলত লড়াই হতো তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের। এবার সেই সমীকরণ পাল্টে গেছে বলে মনে করা হয়। লড়াইয়ের মাঠে আবির্ভূত হয়েছে নতুন শক্তি বিজেপি। তারা জোট করেছে স্থানীয় ‘আদিবাসী পিপলস ফ্রন্ট’-এর সঙ্গে এবং কংগ্রেসের স্থান দখল করে বামফ্রন্টকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। বলা হচ্ছে, ডান ও বামের এ রকম সরাসরি লড়াই ভারতের কোনো রাজ্যে আগে আর হয়নি।

ত্রিপুরায় ভোটার ২৫ লাখেরও কম। ভারতের ভোটার জনমণ্ডলীর তুলনায় এটা অতি নগণ্য। কিন্তু প্রচারণায় বিজেপির ‘তারকা-সমাবেশ’ থেকে স্পষ্ট ছিল যে তারা কতটা গুরুত্বসহকারে নিয়েছে এই নির্বাচনকে। মোদি থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথ পর্যন্ত সবাই এখানে প্রচারযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন গত সপ্তাহগুলোয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি একাধিকবার এসেছেন প্রচারণায় শামিল হতে। তাঁর পরিষদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী—কেউই নির্বাচনী যুদ্ধে স্থানীয় বিজেপিকে মদদ দিতে সফর করে যেতে ভুল করেননি।

হাল ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না কংগ্রেসও। ফলে রাহুল গান্ধীও নির্বাচনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ত্রিপুরায় ঘুরেছেন।

বামদের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার নিজেই তাঁর টিমকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতা সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাতও এসেছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য। কিন্তু ভোটের যুদ্ধে এঁদের আগমন-নির্গমন বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না। কারণ, কেউই তাঁরা ‘ক্যারিশমাটিক’ নন। ক্ষমতায় থাকাকালে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তির বাইরে মানিক সরকারের ইমেজই স্থানীয় বাম কর্মীদের ভরসা।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিতে মানিক সরকার প্রকৃতই এক দারুণ ব্যতিক্রম। অর্থবিত্ত সংগ্রহে তাঁর অনাগ্রহ তাঁকে সমালোচনা করা দুরূহ করে রেখেছে। এবারের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার সময় আয়-রোজগারের যে বিবরণ মানিক সরকার দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, ৬৯ বয়সী এই রাজনীতিবিদের ব্যাংক হিসাবে এ মুহূর্তে মাত্র ২ হাজার ৪১০ রুপি আছে উত্তোলনযোগ্য। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাওয়া বেতন ছাড়াও পার্টিকে তিনি পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সম্পদের অনেকখানিই দিয়ে দিয়েছেন বহুকাল আগে। এখন তাঁর আয় হলো পার্টির কাছ থেকে পূর্ণ সময়ের কর্মী হিসেবে পাওয়া মাসিক পাঁচ হাজার রুপি ভাতা। সর্বমোট ২৬ লাখ রুপির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে তাঁর। ভারতের একটি রাজ্যে আড়াই দশক একনাগাড়ে মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরও সর্বশেষ এক জরিপে দেখা গেছে, তিনি সমকালীন ২৯ জন ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রীর মাঝে সম্পদে সবচেয়ে দরিদ্র।

স্বভাবত, এরূপ রাজনীতিবিদেরা এখন উপমহাদেশের বিরল এক প্রজাতি। তবে ত্রিপুরার ভোটারদের কাছে এর আদৌ কোনো অর্থ রয়েছে কি না, কিংবা অন্যান্য জরুরি সামাজিক ইস্যুর চেয়ে মানিক সরকারের ব্যক্তিগত সততাকে তারা অধিক মূল্য দিতে প্রস্তুত কি না, সেটা জানার জন্য আগামী মার্চের প্রথম শনিবার পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি অবশ্য মানিক সরকারের ব্যক্তিগত সৎ ভাবমূর্তিকে যে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ, তার প্রমাণস্বরূপ দেখা গেছে, নির্বাচনী সভাগুলোয় তামাশা করে তিনি বলেছেন, ‘ত্রিপুরাকে আমরা মানিকের পরিবর্তে হীরা উপহার দিতে চাই।’

শুক্রবার নির্বাচন শেষ হওয়ামাত্র ভারতীয় নির্বাচনী পণ্ডিতেরা ইতিমধ্যে নানারূপ আঁচ-অনুমান করতে শুরু করেছেন ফলাফল নিয়ে। নির্দিষ্ট করে ফলাফল সম্পর্কে অনুমান করা না গেলেও এটা নিশ্চিত, ত্রিপুরায় সিপিএম-বামফ্রন্ট হেরে গেলে সর্বভারতীয় স্তরে দলটি অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। ফলে, তাদের জন্য এটা কেবল একটি নির্বাচন নয়, অস্তিত্বের লড়াই। মরিয়া হয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে শামিল কমিউনিস্ট কর্মীদের কোণঠাসা করতে বিজেপি মূলত যে অফারটি দিচ্ছে, তা হলো ত্রিপুরা ভেঙে আরেকটি রাজ্য গড়ার আশ্বাস। বামফ্রন্ট কর্মীরা এরূপ প্রস্তাবের বিরোধী হলেও স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভোটারদের কাছে এটা এক বড় লোভনীয় প্রস্তাব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এককালের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনপদ ত্রিপুরায় এখন বাঙালিদের সংখ্যাই বেশি। স্বভাবত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন মনে করে, তারা বাঙালিদের আধিপত্যের শিকার। বঞ্চনার এই বোধ থেকেই পৃথক রাজ্যের দাবিটি জনপ্রিয় হচ্ছে এবং বিজেপি-প্রভাবিত মিডিয়াও তাতে ভাবাবেগ যুক্ত করছে। যদি এবার বিজেপি ও আদিবাসী ফ্রন্ট নির্বাচনে জেতে, তাহলে ভারতে আরেকটি রাজ্যের জন্ম আসন্ন বলেই ধরে নিতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর স্বাধীনতাসংগ্রামকে দুর্বল করার এটাও একটা ভালো কৌশল জনপদগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলা। ত্রিপুরার নির্বাচন তাই আসাম-নাগাল্যান্ড-মণিপুর-মেঘালয়সহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজনপ্রধান জনপদগুলোর জন্য এক বড় বিপৎসংকেত। বিজেপি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা চাইছে; সর্বত্র।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক