বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজেপির যুদ্ধ

ভারতের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং সম্প্রতি ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলে ঘোষণা করেছেন। যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষ বা কোনো কালের মানুষ কখনো বলেনি বা লেখেনি, তারা একটা বানরকে মানুষ হতে দেখেছে।’ তাঁর এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে হতবাক করার মতো। এটি বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন সরকারের সর্বশেষ নগ্ন আক্রমণ।

ভারতের সংবিধানমতে, ‘বিজ্ঞানভিত্তিক মনন, মানবিকতা এবং অনুসন্ধান ও সংস্কার’-এর উন্নয়ন ঘটানো প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য; একই সঙ্গে এটি রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মনে করতেন, ধর্মীয় ভাবধারা যেভাবে অসহিষ্ণুতা, কুসংস্কার ও আবেগাশ্রিত ভাবনার বিস্তার ঘটায়, বৈজ্ঞানিক ভাবধারা তা করে না। মুক্ত মানবের চিন্তার জগৎ বৈজ্ঞানিক ভাবধারাকে গ্রহণ করে।

কিন্তু ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাছে এই ধারণা এখন আর সমাদৃত হয় না। দলটির নেতা ও পুরোহিতরা এখন স্কুলশিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, প্রাণের উদ্ভব নিয়ে ধর্মীয় পুঁথি-পুরাণে উল্লেখিত বিভিন্ন তত্ত্বের মতোই বিবর্তনবাদ একটি মামুলি তত্ত্ব ছাড়া কিছু নয়। এই বিষয়কে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ছড়িয়ে দেওয়াই এখন তাঁদের লক্ষ্য।

শুধু ডারউইনই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু, তা নয়। এ বছরের শুরুতে, বিজেপির আরেক বলিষ্ঠ নেতা রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবননী দাবি করে বসেছেন, গরুই হলো একমাত্র প্রাণী, যে নিশ্বাসের সঙ্গে একই সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণ ও বর্জন করে। বিজেপি ও তার অনুসারীদের মধ্যে গরু-বন্দনা এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে পশু রক্ষার নামে তাঁরা মানুষ মারতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না। এই রকমের চিন্তাভাবনা সমর্থন করা বিজেপির বহু সমর্থকের পক্ষেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। সত্যপাল সিং ও বাসুদেব দেবননী দুজনই শিক্ষিত লোক। রসায়নে সত্যপালের ডিগ্রি নেওয়া আছে এবং দেবননী একজন প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী। এরপরও অজ্ঞতাকে নিরুৎসাহিত করার মতো শিক্ষা বা নেতৃত্ব-কোনোটাই তাঁরা অর্জন করতে পারেননি।

একই ঘটনা ঘটেছে রাজস্থান হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি মহেশ চন্দ্র শর্মার ক্ষেত্রে। তিনিও বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রিধারী মানুষ। এই মহেশ চন্দ্র গত বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর জন্মগতভাবে চিরকুমার। শারীরিকভাবে মিলিত না হয়ে ক্রন্দনাশ্রু দিয়ে নাকি সে ময়ূরীকে গর্ভবতী করে। শ্রীকৃষ্ণের মাথার সিকি পাখা হিসেবে ময়ূরের পাখনার ব্যবহারকে তিনি ময়ূরের চিরকুমারত্বের প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন।

এমনকি বিজ্ঞানচিন্তায় আঘাতকারীদের দলে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও যোগ দিয়েছেন। মোদি নিজেকে একুশ শতকের একজন প্রযুক্তিবান্ধব নেতা হিসেবে চিত্রায়িত করতে পছন্দ করেন। সেই তিনি ২০১৪ সালের অক্টোবরে মুম্বাই হাসপাতাল উদ্বোধনের সময় বলেছিলেন, প্রাচীন ভারতে যে নিখুঁত প্লাস্টিক সার্জারি ছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মানবদেহে হাতির মাথা বসানো গণেশ দেবতা। মোদি বলেন, ‘মহাভারতে পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে তখনকার মানুষ জিনবিজ্ঞান সম্পর্কে ভালোভাবে জানত।’ কিন্তু মোদির মাথায় একবারও এল না, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ঘাড়ওয়ালা শিশুর গলার সঙ্গেও হাতির বিশালাকৃতির মাথা মিশ খাবে না।

পরিহাস হলো সত্যি সত্যি ভারতই প্লাস্টিক সার্জারির অগ্রদূত। এই দেশ বিশ্বের প্রথম শল্যচিকিৎসক ঋষি শশ্রুতের জন্ম দিয়েছিল এবং প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মাটি খুঁড়ে বিশ্বের প্রথম শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি (যা প্রথম শতকের বলে মনে করা হয়) আবিষ্কার করেছিলেন।

প্রাচীন বইপত্রে এখানে রাইনোপ্লাস্টি অপারেশনেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা সেই সব মহান বিজ্ঞানীর প্রতি চূড়ান্ত অশ্রদ্ধার নামান্তর। একইভাবে মোদি ২০১৪ সালে স্কুলশিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তন কোনো পরিবেশগত সমস্যা নয়; বরং এটিকে নিয়ত পরিবর্তনশীল শীত ও গরমের সঙ্গে মানুষের খাপ খাইয়ে নেওয়ার সুযোগ হিসেবে ভাবা উচিত। জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যমে তিনি বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ‘সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

বিজেপির এই পশ্চাৎপদ দর্শন ও ভণ্ডামি যে শুধু রাজনীতিকেরাই প্রচার করছেন, তা নয়। এর বাইরেও অনেকে আছেন। সমকামীদের ‘নিরাময়’ করার ওষুধ বিক্রি করা যোগগুরু ও আয়ুর্বেদ উদ্যোক্তা বাবা রামদেবের মতো অনেকেই মোদির ঘনিষ্ঠ লোক ও সহচর। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতে ঝাঁক ঝাঁক গুরু ধর্মীয় আখড়া থেকে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া অর্থে পরে মূলধারার বড় বড় ব্যবসায়ী বনে গেছেন। নতুন যুগের ‘সদ্গুরু’ যোগী বাসুদেব ২০১৫ সালে চন্দ্রগ্রহণের সময় খাবার খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছিলেন, এ সময় খাবার খেলে সেই খাবার বিষ হয়ে যায়।

কোনো কোনো কর্মকর্তা দাবি করেছেন, জঙ্গি বিমান ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ সব ধরনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও অর্জন হয়েছে বৈদিক যুগে। তাঁদের সারকথা হলো প্রাচীন ভারতবর্ষের কাছে সব প্রশ্নের জবাব ছিল এবং আধুনিক ভাবনাচিন্তা ও জীবনযাপনের যেসব রীতি বাইরে থেকে আসছে, সেগুলোর চেয়ে প্রথাগত ভারতীয় বিশ্বাস ও জীবনযাত্রা অনেক বেশি মহান।

বিজেপি ও তার সহযোগীরা ঘুরেফিরে প্রাচীন ভারতের রীতিনীতিকে সামনে আনতে চায়; কারণ তারা বিশ্বাসনির্ভর সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে তুলে ধরতে চায় এবং এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রিয় হয়ে উঠতে চায়।

তাদের কাছে ধর্ম কোনো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং প্রথাগত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমে তারা সামাজিক আচার ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়। বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঠেকানোর হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে তারা ব্যবহার করতে চায়।

যখন মন্ত্রীরা ডারউইনবাদ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কিংবা গরুর অলৌকিক ক্ষমতার কথা প্রচার করেন, তখন বুঝতে হবে তাঁরা শুধু বৈজ্ঞানিক থিওরি ও বিশ্বাসনির্ভর ব্যাখ্যার মধ্য থেকে যেকোনো একটি বেছে নিতে বলার জন্য এসব বলছেন না। বরং তাঁরা এর মধ্য দিয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চান, বিশ্ববাসীর ভাবনার সঙ্গে ধর্মীয় চিন্তার জগৎ মিশে আছে। এই বক্তব্য প্রচারের মধ্য দিয়ে তাঁরা ধর্মীয় আবরণে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চান।

বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ এখন এই ধরনের লোকাচারবাদকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বিজেপি যে প্রথাগত বিশ্বাসের কথা বলে, তার সত্য-মিথ্যা মুক্তভাবে যাচাই করতে উদ্বুদ্ধ করে বিজ্ঞান। এ কারণে যেহেতু বিজেপি সেক্যুলার ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়, সে জন্য তারা ভারতে বিজ্ঞানের অবস্থানকে দুর্বল করতে চায়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর: লেখক ও ভারতের সাবেক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী