শিক্ষামন্ত্রীর কী দোষ?

প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষামন্ত্রীর কী দোষ? খুবই ন্যায্য প্রশ্ন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যদি ফাঁস হয়, তার জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে কেন পদত্যাগ করতে হবে? তিনি নিজে তো আর প্রশ্নপত্র ফাঁস করেননি। অথবা মনে করা যাক, একটা সেতু ভেঙে পড়েছে বা একটা ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটল। তাহলে কি যোগাযোগ বা রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে?

বাংলাদেশে বারবার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা কেউ দায়দায়িত্ব নিতে রাজি নন। শিক্ষামন্ত্রীকে সব দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, সেটি অনুসরণ করলে অবশ্যই কবুল করতে হবে, এতে মন্ত্রীর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এই যুক্তি অনুসারে, অফিসের যে কেরানি অথবা ছাপাখানার যে ফোরম্যানের হাত দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে। একই যুক্তিতে সেতু ভাঙলে বা ট্রেন দুর্ঘটনা হলে সেই সেতুর ইঞ্জিনিয়ার বা কনট্রাক্টর এবং রেলগাড়ির চালককে খপাৎ করে ধরতে হবে, মন্ত্রীকে নয়।

কিন্তু আপনি যদি ভারতের রেলমন্ত্রী হন এবং আপনার নাম হয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, তাহলে ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে মাহবুবনগরের রেল দুর্ঘটনায় ১১২ জন নিহত হলে আপনি নিজে থেকেই ইস্তফা দেবেন। তিনি রেলের চালক ছিলেন না, কিন্তু যে দপ্তরের অধীনে রেল চলাচল করে, তার দায়িত্বে ছিলেন। যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করবেন, এমন দায়িত্ব মাথায় নিয়েই তিনি দেশের রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন। অতএব, নিজের বিবেকের কাছে জবাবের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দিলেন। কিছুটা বিলম্বের পর নেহরু তা গ্রহণ করে বলেছিলেন, এটিই হবে যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত। এই ব্যর্থতার দায়ভার দপ্তরের প্রধানের, অধস্তন কোনো কর্মচারীর নয়।

কিন্তু বাংলাদেশের মন্ত্রী তো ভারতের শাস্ত্রী নন, তিনি কেন নিজ দপ্তরের ব্যর্থতার দায়ভার নিজের মাথায় তুলে নেবেন? পাঠকের মনে থাকতে পারে, অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে লঞ্চডুবি হলে বাংলাদেশের এক সাবেক নৌমন্ত্রী বলেছিলেন, এতে তাঁর নিজের কোনো দায়দায়িত্ব নেই।

কী অকাট্য যুক্তি!

আচ্ছা, ঠিক আছে, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এক ভিন্ন সময়ের মানুষ, তিনি ‘নেহরুবাদী’ মানুষ ছিলেন, আমাদের আজকের দিনের হিসাবে বড্ড বেশি আদর্শবাদী বা ‘আইডিয়ালিস্ট’। তাহলে অতি সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। ২০১৪ সালের কথা, দক্ষিণ কোরিয়ায় কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দুটি ভুল রয়ে গিয়েছিল। তা দেখে প্রথমে ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হলো, তারপর তাদের অভিভাবকেরা। অধিকাংশের অভিযোগ শিক্ষা বোর্ডের কাছে। কোনো ওজর ছাড়াই শিক্ষা বোর্ডের প্রধান পদত্যাগ করলেন। তারপর নিজের দায়িত্ব স্বীকার করে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে শিক্ষামন্ত্রী হুয়াং ইয়া-উয়ে বললেন, ‘আমি ক্ষমা চাইছি। আমি মানছি, প্রশ্নপত্র তৈরির প্রক্রিয়াকে আরও মজবুত করতে হবে।’

সেই ২০১৪ সালেই এক ফেরি দুর্ঘটনার জন্য নিজের দায়দায়িত্ব মাথায় নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং হোয়াং-ওয়ান নিজে থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই দুর্ঘটনা এড়াতে ব্যর্থ হওয়ার সব দায়িত্ব আমার, অতএব আমি পদত্যাগ করছি।’ তিনি বলেছিলেন।

আরও সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। অক্টোবর ২০১৭ সালের কথা। সে বছরের জুলাই মাসে মালিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কর্তব্যরত দুজন ওলন্দাজ সৈনিক প্রশিক্ষণের সময় এক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই নিয়ে তদন্ত শেষে এক প্রতিবেদনে বলা হলো, সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনা হয়, তা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তো, এমন অপরাধের জন্য দোষ কার? সেনাবাহিনীর কোনো জেনারেলের অথবা কোনো সেনা কন্ট্রাক্টরের? এই নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক শেষে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করলেন কে, জানেন? সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনিন হেনিস।

পাঠক হয়তো বলবেন, নেদারল্যান্ডস উন্নত দেশ, তাদের সঙ্গে কি আমাদের তুলনা চলে? ঠিক আছে, একটি উন্নয়নশীল দেশের সাম্প্রতিক উদাহরণ নেওয়া যাক। গত অক্টোবরে কোস্টারিকায় যাত্রীবোঝাই বাসের চালক গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় বাসটি নদীতে পড়ে গেলে পাঁচজন যাত্রীর মৃত্যু হয়। সব দোষ গিয়ে পড়ল-না, সেই বাসের চালক বা বাস কোম্পানির মালিকের ওপর নয়, দেশের পরিবহনমন্ত্রী কার্লা গঞ্জালেসের ওপর। তিনি দায়দায়িত্ব স্বীকার করে বললেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা পালনে ব্যর্থতার জন্য তিনি পদত্যাগ করছেন।

যে কারণে নিজে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী না হয়েও এসব কর্তাব্যক্তি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন অথবা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, তাকে ইংরেজিতে বলে অ্যাকাউন্টেবিলিটি। বাংলায় বলতে পারেন জবাবদিহি। দেশে কোনো ক্ষেত্রে যখন কোনো সাফল্য আসে, তখন সেই সাফল্য দাবি করেন সে দেশের সরকারপ্রধান অথবা সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। যেমন আমরা বছরে এক হাজার কোটি ডলারের তৈরি কাপড় রপ্তানি করছি। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দেশের বাণিজ্যনীতি-এই যুক্তিতে সেই কৃতিত্ব দেশের প্রধানমন্ত্রী নিতেই পারেন। প্রশ্ন হলো, নেতারা কৃতিত্ব নেবেন, ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নেবেন না, তা কেমন করে হয়? জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকলে এমনটি হতো না। জবাবদিহির দুটো দিক-একদিকে রয়েছে দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া, অন্যদিকে অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ। কোনো ব্যর্থতা-তা প্রশ্নপত্র ফাঁস হোক অথবা নদীতে লঞ্চডুবি-তার কারণ কী, প্রথম কাজ হলো তা খুঁজে বের করা। এই দায়িত্ব পালন করার কথা সরকারের ভেতরে একটি জবাবদিহি দপ্তরের।

আমেরিকায় এই দায়িত্ব পালন করে গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি অফিস, যা কিনা অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ভিত্তিতে গঠিত হয়ে থাকে। তদন্তের পর যে প্রতিবেদন তৈরি হবে, তা পাঠানো হয় কংগ্রেসে বা আইনসভায়। তারাই ঠিক করবে কোন দপ্তরের ব্যর্থতার জন্য কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার ওপর ন্যস্ত এই দায়িত্ব পালনের জন্য আইনসভা প্রয়োজনমতো উন্মুক্ত অথবা রুদ্ধদ্বার শুনানির ব্যবস্থা করে থাকে। সরকারের যেকোনো পর্যায়ের সদস্যকে সেই শুনানিতে হাজিরার জন্য ডাকা হয়। কেউ অস্বীকার করলে আদালতের মাধ্যমে তাঁদের শুনানিতে আসতে বাধ্য করা যায়। আমেরিকায় এখন গত নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে কংগ্রেসে যে তদন্ত চলছে, তা এই জবাবদিহির অংশ হিসেবেই।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জবাবদিহির নানা উদাহরণ হয়তো আমরা দিতে পারি, কিন্তু খুব একটা লাভ তাতে হবে বলে মনে হয় না। ধর্মের কথা যেমন কেউ কেউ শোনে না, তেমনি কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি (পড়ুন মন্ত্রী) কলাম লেখকের সস্তা উপদেশে কান দেন না।

দেবেনই বা কেন? সব দায়দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়ে গেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এরপরও কি কারও কোনো প্রশ্ন রয়েছে?

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি