বই-ঠকি কৌতুক

আমার কৈশোরে আমি একবার সৈয়দ শামসুল হকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পড়ার বাইরে তরুণ লেখককে পরামর্শ দিন। তিনি বলেছিলেন, পড়ো, পড়ো এবং পড়ো।

এবং তিনি তাঁর গল্পের কলকবজা বইয়ে বলেছেন, লেখক হচ্ছে কাঠমিস্ত্রির মতো।

সৈয়দ শামসুল হক যা বলেছেন, উইলিয়াম ফকনারও তাই বলেছিলেন। আমি ফকনারের কথাটা অনুবাদ করে দিচ্ছি, ‘পড়ো, পড়ো, পড়ো। সবকিছু পড়ো। আবর্জনা, ধ্রুপদি, ভালো, মন্দ। ঠিক যেমনটা করে একজন কাঠমিস্ত্রি, আর তার শাগরেদ তাকে দেখে, দেখে দেখে শেখে। পড়ো। তুমি এটা আত্মস্থ করবে। তারপর লেখো। যদি ভালো হয়, বুঝতে পারবে। যদি খারাপ হয়, জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেবে।’

এবার একটা কৌতুক বলার চেষ্টা করি।

‘পড়ো, পড়ো, পড়ো।’

‘পড়েছি তো। এ পর্যন্ত ১১ বার পড়েছি। প্রেমে।’

অবশ্য আইনস্টাইন বলেছেন, মানুষ যে প্রেমে পড়ে, সে জন্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দায়ী নয়।

মাধ্যাকর্ষণের কথা যখন এসেই গেল, এ-সংক্রান্ত আরেকটা কৌতুক বলে নেওয়া ভালো।

আমি মহাকর্ষ বলবিরোধী একটা বই পড়ছি। আমি কিছুতেই বইটা মাথা থেকে নামাতে পারছি না।

আচ্ছা, এই কৌতুকটা আমার ভালো লেগেছে, এটা বলি-শেক্সপিয়ার পেনসিল দিয়ে না লিখে কলম দিয়ে লিখেছিলেন কেন? কারণ, তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, কোন পেনসিল দিয়ে লিখবেন-টু বি নাকি নট টু বি। মনে হয় তিনি থ্রি বি পেনসিল খুঁজছিলেন।

আচ্ছা, বর্তমান যুগ তো এমসিকিউর যুগ। এক ছেলেকে বলা হলো, ‘তোমার পিতার নাম লেখো।’ সে বলল, ‘আপনি চারটা নাম লিখে দেন, আমি টিক দিয়ে দিচ্ছি।’ এবার আমরা ভালো পাঠকের সংজ্ঞার এমসিকিউ করব। সঠিক উত্তরে টিক দিন। এটা ভ্লাদিমির নাবোকভ থেকে নেওয়া।

ভালো পাঠক কী রকম হয়?

১. পাঠক একটা বুক ক্লাবের সদস্য হবে। (যেমন কিআ বুক ক্লাব)। ২. পাঠক গল্পের চরিত্র হিসেবে নিজেকে কল্পনা করবে। (নিজেকে নায়ক বা নায়িকা ভাববে)। ৩. পাঠক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সজাগ হবে। ৪. পাঠক ঘটনা ও সংলাপহীন গল্পের বদলে ঘটনা ও সংলাপযুক্ত গল্প পছন্দ করবে। ৫. পাঠক গল্পটির ওপরে বানানো চলচ্চিত্র দেখবে। ৬. পাঠক একজন হবু লেখক। ৭. পাঠকের কল্পনাশক্তি থাকবে। ৮. পাঠকের স্মৃতিশক্তি ভালো থাকবে। ৯. পাঠকের ডিকশনারি থাকবে। ১০. পাঠকের রসবোধ থাকবে।

নাবোকভ বলেছেন, শেষের চারটা-কল্পনাশক্তি, স্মৃতিশক্তি, অভিধান আর রসবোধ যাঁর আছে, তিনি ভালো পাঠক। (সূত্র: সাহিত্য প্রতিচ্ছায়া, শেখর বসু) ‘গুড রিডার্স অ্যান্ড গুড রাইটার্স, ভ্লাদিমির নাবোকভ’ গুগল সার্চ করে আপনারা অনলাইনে পুরো বক্তৃতা পড়ে নিতে পারেন। তবে আপনারা যাঁরা উপন্যাস পড়ার সময় নিজেকে নায়ক বা নায়িকা হিসেবে কল্পনা করতে থাকেন, সাবধানতার খাতিরে জেনে নিতে পারেন, বইয়ে নায়ক বা নায়িকার মৃত্যু হবে কি না।

বইয়ের কতগুলো সুবিধার কথা বলুন।

১. বইয়ের কোনো বিজ্ঞাপন বিরতি নেই। ২. বই যে পর্যন্ত পড়েছি, সেখান থেকে চালু করার জন্য রিমোট টিপতে হয় না। ৩. লাইব্রেরি হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে আপনি আপনার কৌমার্য বিসর্জন না দিয়েই নিষ্পাপতা বিসর্জন দেন। ৪. বইয়ের উত্তেজনাকর মুহূর্তে চার্জ চলে যায় না। ৫. বই হাতে নিয়ে ঘুরলে লোকে ইন্টেলেকচুয়াল ভাবে এবং পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, ইন্টেলেকচুয়াল ছেলেদের প্রেমে মেয়েরা বেশি পড়ে। ৬. বইয়ের মধ্যে প্রেমপত্র চালান করা যায়।

প্রেমপত্র নিয়ে একটা কৌতুক আছে, যেটা থেকে একটা গল্প আর একটা নাটক আমি রচনা করেছিলাম।

ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়। এক শিক্ষার্থী এক সহপাঠিনীকে প্রেমের প্রস্তাব দিল। সহপাঠিনী তার কোনো জবাব দিল না। ৩০ বছর পরে তাদের দুজনের আবার দেখা। লোকটা বলল, ‘তোমাকে যে আমি প্রস্তাব করেছিলাম, তুমি হ্যাঁ-না কিছু বলোনি কেন?’

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমিই হ্যাঁ-না বলিনি, না তুমিই আর আমাকে পাত্তা দাওনি? আমি যে তোমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিকস বইটা দিয়েছিলাম, সেটা কি তুমি খুলে দেখেছিলে?’

‘না না। আমি মূল বই পড়ি নাই। সব সময় নোট পড়তাম।’

‘ও হো! ওই বইয়ের মধ্যেই তো আমি তোমাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। তার জবাব না পেয়ে আমি হতাশ হয়েও পড়েছিলাম।’

‘ও হো! এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন নোট না পড়ে মূল বই পড়া উচিত।’

এইখানে আমি কবি রফিক আজাদ থেকে উদ্ধৃতি দিই, ‘বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই, পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই।’

আর আমার কিশোর-তরুণ পাঠকদের আমি বলি, বইয়ের সব গল্প কবিতা প্রবন্ধ পোড়ো। যেগুলো সিলেবাসে নেই, সেসবও পড়বে। গণিত বইয়ের অনুশীলনীর আগের বিবরণগুলো পড়বে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক