যুক্তরাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা ও সামরিকীকরণের বিপদ

বিশ্বের মহাক্ষমতাধর দেশগুলোর কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে বিশ্বে আবার বহুমেরুত্ব ফিরে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে চীনের পুনর্বার জেগে ওঠা এবং রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন এই শতাব্দীর আন্তর্জাতিক সামরিক গতির প্রধান দিক হয়ে উঠেছে। হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প বসার প্রথম বছরেই চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিবেশ শীতল হয়েছে; পাশাপাশি তার শত্রুদেশ বলে বিবেচিত দেশগুলোর সঙ্গেও তার সম্পর্ক শীতলতর হয়েছে।

পাঁচ বছর আগে সি চিন পিং যখন চিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তিনি পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংলাপের ভিত্তিতে ‘মহাশক্তিধরদের নতুন ধরনের সম্পর্ক’ শীর্ষক একটি সম্পর্কের ধারণা দেন। এই সম্পর্কের ধারা অনুসরণ করে একটি ক্ষমতাধর দেশ অন্য একটি ক্ষমতাধর দেশের জাতীয় স্বার্থকে সম্মান করবে বলে তিনি মত দেন। কিন্তু চীন মুখে ভালো ভালো কথা বললেও সব সময় সেসব কথা যে অনুসরণ করে না, তা দক্ষিণ চীন সাগরে তার একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা দেখেই বোঝা যায়। তা ছাড়া চিন পিংয়ের কূটনৈতিক বিভাগের চেয়ে পিপলস লিবারেশন আর্মির সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা দেখেও তাঁর সেই বক্তব্যের স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। এমনকি চিন পিং সবাইকে অবাক করে দিয়ে সামরিক উর্দি পরার আগ্রহ পর্যন্ত দেখিয়েছেন।

অন্যদিকে গত দশকে রাশিয়া সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দুটি ভূখণ্ডে দখলাভিযান চালিয়েছে এবং সামরিক খাতে ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়েছে। শীতল যুদ্ধের পর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ‘ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি’ নামে একটিমাত্র পারমাণবিক চুক্তি হয়েছে এবং এটি এখনো বলবৎ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়েই উভয়ের বিরুদ্ধে ওই চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছে।

বর্তমানে মহাশক্তিগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেটিকে আমাদের অতিরঞ্জিত করা ঠিক হবে না। গত তিন মাসে মার্কিন প্রশাসন ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি, ন্যাশনাল ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি ও নিউক্লিয়ার পশ্চার রিভিউ গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রকাশ করেছে।

এসব নথিতে চীন ও রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় বিচার করলে দেখা যাবে, সবচেয়ে বড় হুমকিটি কিন্তু চীন বা রাশিয়া থেকে আসছে না; বরং যুক্তরাষ্ট্রের নিজের বিভ্রান্তিকর পররাষ্ট্রনীতির মধ্যেই এই হুমকি নিহিত রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র এতকাল ধরে বৈশ্বিক বিষয়ে খবরদারি করে আসছে। কখনো কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে গেছে, কখনো কারও সমর্থনে কাজ করেছে। এভাবেই দেশটি এগিয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের সেই ঐতিহ্যবাহী কৌশল থেকে সরে এসে অভ্যন্তরীণ স্বার্থের বিষয়ে বেশি জোর দিতে চেয়েছেন। এতে বৈশ্বিক নেতৃত্বের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত কম হস্তক্ষেপের সুযোগে, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এটি সামরিক প্রতিযোগিতাকে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। স্মরণে রাখা জরুরি, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের ইস্যুতে নাক গলাবেন না বললেও সম্প্রতি সামরিক সম্ভারের দম্ভ দেখিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনকে ভয় দেখাতে চেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় বিশ্বের এক নম্বরে। এই ব্যয়ের পরিমাণ দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনের ব্যয়ের তিন গুণ এবং তৃতীয় স্থানে থাকা রাশিয়ার ব্যয়ের প্রায় নয় গুণ। এর পরে থাকা আটটি দেশের সমান তার সামরিক ব্যয়। বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক পারমাণবিক চুল্লি তার দখলে। এরপরও ট্রাম্প তাঁর দম্ভ প্রকাশ করতে গিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তা প্রতিপক্ষের মনে ভয় ধরানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

নিউক্লিয়ার পশ্চার রিভিউয়ের নথিতে যুক্তরাষ্ট্রকে তার অন্তর্মুখী অবস্থান থেকে সরে এসে আগের মতো বৈশ্বিক বিষয়ে অগ্রণী হতে বলা হয়েছে। এতে বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আসবে এবং রাশিয়ার উদ্ধত তৎপরতাকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হবে। এতে বিশেষ করে পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে না, বরং অনেকাংশে কমে যাবে।

ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয় ছাড়াও চীন ও রাশিয়ার বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার যুক্তরাষ্ট্রকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। চীন ও রাশিয়াকে বিনা বাধায় সমরাস্ত্রের পাহাড় গড়তে দেওয়া আগুনের ওপর জ্বালানি ফেলে দেওয়ার নামান্তর। ফলে বিশ্বকে নতুন পারমাণবিক হুমকি থেকে বাঁচানোর স্বার্থে হলেও যুক্তরাষ্ট্রকে অন্তর্মুখী নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উত্তর কোরিয়ার রাশ টেনে ধরতে হবে। নতুন একটি সামরিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার উত্তেজনা থেকে বিশ্বকে নিরাপদ করতে ট্রাম্পকে তাঁর নীতি অবশ্যই বদলাতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
হাভিয়ের সোলানা ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব