সবার জন্য নাগরিক পেনশন!

২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এই বাজেটে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে লাগাতার তৃতীয় মেয়াদের সরকারের শাসনদর্শন, উন্নয়ন ও সেবাকৌশল এবং কর্মসূচির রূপরেখা। এসব দর্শন ও কৌশলের অংশ হিসেবে ‘জাতীয় নাগরিক পেনশন’ ব্যবস্থার একটি রূপরেখা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতির বিষয় সম্প্রতি জানা গেল।

১ ফেব্রুয়ারি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন ফান্ড হস্তান্তরের একটি পাইলট প্রকল্প উদ্বোধনকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং অর্থসচিব মুসলিম চৌধুরী দুজনই সব নাগরিকের জন্য পেনশন-ব্যবস্থা প্রবর্তনে সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। গত তিনটি বাজেটেই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আশা করা হচ্ছিল, বিশেষত দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১৫ সালে ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল’ গৃহীত হওয়ার পর থেকে সর্বজনীন নাগরিক পেনশন বিষয়ে নাগরিক প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তুতিপর্বে অর্থমন্ত্রী ও অর্থসচিবের এ বিষয়ে প্রদান করা বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করা হচ্ছে।

বর্তমানে দেশে ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪৮টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। এসব কর্মসূচির মধ্যে সরকারি বাজেটে যে বরাদ্দ, তা এককভাবে ছয় লাখের মতো সরকারি কর্মচারীর জন্য ২৫ শতাংশ এবং আরও ৪-৫ শতাংশ দরিদ্র পুরুষ-নারীদের মধ্য থেকে প্রায় ৩০ লাখ, যাঁরা ৬৩ (নারী) ৬৫ (পুরুষ) বছর বয়সসীমা অতিক্রম করেছেন, তাঁদের প্রতি মাসে দেওয়া হয়। দেশে সাধারণভাবে বয়স্কদের জন্য পৃথকভাবে অন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম যথা স্বাস্থ্য, আবাসন ও নিয়মিত আয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি স্বকর্মে নিয়োজিত, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক, বেসরকারি চাকরিজীবী, যাঁরা সারা জীবন বা জীবনের একটি বড় সময় রাষ্ট্রকে নিয়মিত কর দিয়ে এসেছেন, তাঁদের জন্য কোনোরূপ পেনশন-ব্যবস্থা এ দেশে নেই। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশ যুগপৎভাবে ‘মধ্যম আয়ের’ দেশ এবং একটি আদর্শ ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ হয়ে উঠতে পারে। সেই লক্ষ্যে দেশের প্রবীণ নাগরিকদের সচ্ছল, নিরুদ্বেগ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনব্যবস্থার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে সর্বজনীন নাগরিক পেনশন, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবাদানের বাস্তব কার্যক্রম প্রয়োজন। মন্ত্রণালয় তথা সরকারের বিবেচনার জন্য সেই লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ দেওয়া হলো।

প্রথমত, জাতীয়ভাবে নাগরিক পেনশন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। তবে জীবনচক্রের ভিত্তিকে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় বেসরকারি চাকুরে ও প্রবীণদের জন্য যে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় ২০১৫ সালের কৌশলপত্রে উল্লেখ রয়েছে, তা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত নয়। এখানে তিন স্তরে বেসরকারি ব্যক্তিদের পেনশনের প্রথম স্তর হচ্ছে অতিদরিদ্র বয়স্ক নারী-পুরুষের জন্য সরকারি অর্থে ন্যূনতম আয়ের সংস্থান; দ্বিতীয় স্তরে আনুষ্ঠানিক বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘কনট্রিবিউটরি পেনশন স্কিম’ এবং তৃতীয় স্তরে হচ্ছে স্বেচ্ছায় স্ব-অর্থে গৃহীত বেসরকারি পেনশন স্কিম। এই তিন স্তরের পেনশন-ব্যবস্থাকে কোনোভাবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পেনশন-ব্যবস্থার সুগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা যায় না।

জাতীয় নাগরিক পেনশন-ব্যবস্থা হিসেবে একটি ব্যবস্থা চালু করতে হলে প্রথম অগ্রাধিকার হবে একটি ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ গঠন, যা অবশ্য অর্থসচিবের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হবে ‘জাতীয় পেনশন তহবিল গঠন’। এই তহবিলের বহুমুখী উৎস থাকতে পারে। প্রধান উৎস হবে ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর প্রদানকারীদের আয়করের একটি অংশ। অর্থাৎ প্রতিবছর যাঁরা আয়কর দিয়ে থাকেন, তাঁদের আয়করের নির্দিষ্ট একটি অংশ ২-৩ শতাংশ জাতীয় পেনশন তহবিলে হস্তান্তর। দ্বিতীয় উৎস হিসেবে সরকার প্রতিবছর বাজেট থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ স্থানান্তর করবে। তৃতীয় উৎস হবে কর্মকর্তা-কর্মচারী (সরকারি-বেসরকারিনির্বিশেষে) চাকরিজীবীর নিজের এবং সংগঠনের প্রদেয় অংশ। এভাবে যে অর্থ প্রতিবছর জাতীয় পেনশন তহবিলে জমা হবে, তা সরকার বিভিন্ন লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে ওই তহবিলের আকার ও পরিমাপ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করবে।

বর্তমান জনমিতি কাঠামোয় ষাটোর্ধ্ব বয়সের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশের কাছাকাছি। আগামী ২৫ বছরে তা ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। ওই জনসংখ্যার পেনশন প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থসংস্থান সামনে রেখেই এই তহবিল গঠনের পরিকল্পনা করতে হবে।

আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বেসরকারি কর্মচারীদের পেনশন-ব্যবস্থা তাঁদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাছে ন্যস্ত করা বা আনুষ্ঠানিক খাতের বাইরের ব্যক্তিদের জন্য তাঁদের নিজস্ব কনট্রিবিউশন সংগ্রহ বা বিশেষ বিমা-ব্যবস্থা ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে সুবিধাজনক হবে বলে মনে হয় না। ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ নামক একটি নতুন একক সংগঠনের আওতায় সরকারি-বেসরকারি সব ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে একীভূত হওয়াই যুক্তিযুক্ত। এ বিষয়ে একটি কমিশন করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ গ্রহণ করা উচিত। শুধু নির্বাচন সামনে রেখে জনতুষ্টির জন্য অপরিকল্পিতভাবে তাড়াহুড়া করে কিছু করা উচিত হবে না।

এ বিষয়ে বিবেচনার জন্য শুধু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করব। প্রথমত, সরকারি কর্মচারীদের বিরাজমান পেনশন-ব্যবস্থায় আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য দুটি বিষয় এবং ভবিষ্যৎ নাগরিক পেনশনের জন্য একটি বিষয়। সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনযোগ্য বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের অনেকে পুরোনো বেতন স্কেলে অবসরে গেছেন এবং অবসরকালে পুরো পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ড নগদায়ন করেছেন। বর্তমানে তাঁদের অনেকে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। তাঁদের বয়স ৬২ থেকে ৮০ পর্যন্ত হতে পারে। তাঁরা বর্তমানে মাসে সামান্য চিকিৎসাভাতা ও উৎসবভাতা পেয়ে থাকেন। এসব বয়স্ক মানুষ আগামী অর্থবছর থেকে যত দিন বেঁচে থাকবেন, ওই সময়ের জন্য তাঁদের পুনরায় সরকারি কর্মচারীর প্রাপ্য পেনশনের নিয়মে মাসিক পেনশনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করব। এটি সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি মহানুভবতা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই স্কিমের আওতায় পেনশনভোগীর সংখ্যা প্রতিবছরই হ্রাস পাবে এবং ১০ বছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় চলে আসবে। এই খাতে সরকারের ব্যয় ১০-১৫ কোটি টাকার বেশি হবে না।

তা ছাড়া ১০ বছর ধরে নিয়মিত আয়কর প্রদানকারী যাঁরা ৬০-৬২ বছর বয়সসীমা অতিক্রম করেছেন, কিন্তু কোনো সরকারি পেনশন স্কিমের আওতাভুক্ত নন, আগামী অর্থবছর থেকে তাঁদের প্রদত্ত আয়করের আনুপাতিক একটি হার নির্ণয় করে নাগরিক পেনশনের আওতাভুক্ত করা যেতে পারে। এভাবে নাগরিক পেনশনের সূচনা আয়কর প্রদানকারীদের দিয়েই শুরু করা যেতে পারে।

 সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালু হলে তা ধনী ও দরিদ্র সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত আয়কর প্রদান একটি প্রধান নির্ণায়ক হওয়া উচিত। বর্তমানে বেসরকারি চাকরিজীবীরা, প্রতি মাসে বেতনের উৎসে যাঁদের আয়কর কাটা হয়, সেই আয়করের কোনো সুবিধাই তাঁরা ভোগ করেন না। সন্তানের শিক্ষা, নিজের ও পরিবারের চিকিৎসা, আবাসন—কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ কোনো অগ্রাধিকার নেই। সে কারণে সরকারকে কর দেওয়া নিরর্থক মনে হয়। জাতীয় নাগরিক পেনশনে আয়কর প্রদানকারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে এই কর্মসূচি চালু করা হলে দেশে কর প্রদানকারীর সংখ্যা ও হার দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে আমাদের ধারণা।

ড. তোফায়েল আহমেদ: নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক
[email protected]