অধ্যক্ষ ও তদন্ত কমিটি

রংপুরের কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুল লতিফ মিয়ার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ: দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ। কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাঁর ‘অপকর্মের’ বিচার চাইছেন, তাঁর অপসারণের দাবিতে তাঁরা আন্দোলনও করছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পর্যন্ত পালিত হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের কার্যালয়ে তালা পর্যন্ত ঝুলিয়েছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই অধ্যক্ষ যেনবা রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী।

রহস্যটা এ কারণে যে, বহু আগে থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি শাস্তি থেকে পার পেয়ে আসছেন। যেমন ১৯৯৯ সালে প্রভাষক থাকা অবস্থায় পদোন্নতি পরীক্ষায় তিনি নকলসহ ধরা পড়েছিলেন। এই অপরাধের দায়ে সরকারি কর্ম কমিশন তাঁকে নয় বছরের জন্য পরীক্ষায় বসার অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও চাকরিতে তাঁর উন্নতি হয়েছে, তিনি অধ্যক্ষ পর্যন্ত হয়েছেন।

কিন্তু কেমন অধ্যক্ষ? তাঁর কলেজের শিক্ষকদের অভিযোগ এ রকম: অধ্যক্ষ হিসেবে কারমাইকেল কলেজে যোগ দেওয়ার পর থেকে প্রায় দেড় বছরে আবদুল লতিফ ওই কলেজের অন্তত দুই কোটি টাকা নানা কৌশলে আত্মসাৎ করেছেন। তাঁর অর্থ আত্মসাতের খাতগুলোর মধ্যে এমনকি পরীক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশিকা বিক্রি পর্যন্ত আছে। পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে ফি নেওয়া হয়, সেখান থেকেও তিনি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে তাঁর সহকর্মীরা অভিযোগ করেন। একটি উদাহরণ এ রকম: কলেজে ২০১৪ সালের মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষা, যা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালে, সেই পরীক্ষার ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করা হয়। অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ সেখান থেকে ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছেন ‘অডিট খরচ’-এর নাম করে। ওই পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক এ টি এম রিয়াজুল ইসলাম স্বয়ং অভিযোগ করেছেন, অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ তাঁর কাছ থেকে দুই দফায় ওই টাকা নিয়েছেন।

অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ ভিত্তিহীন, ষড়যন্ত্রমূলক ইত্যাদি বলে নাকচ করেছেন। কিন্তু কলেজটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি থেকে সরেননি, তাঁরা তাঁর বিচার ও অপসারণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের আন্দোলন এবং এ সম্পর্কে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাঁর প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গত সোমবার সেই তদন্ত কমিটি রংপুরে গিয়ে তদন্তকাজ শুরু করে।

কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির আচরণ ও কথাবার্তা সম্পর্কে কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেসব অভিযোগ করছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে তদন্ত কমিটির আচরণ তদন্ত করার জন্যই আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। অভিযোগ হলো, তদন্ত কমিটি ঢাকা থেকে রংপুরে গিয়ে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ আবদুল লতিফকে সঙ্গে নিয়েই ‘মধ্যরাতে’ও তদন্তের কাজ করে। তার আগে তদন্ত কমিটির সদস্যরা স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাদের ডেকে নেন, যাঁরা অধ্যক্ষের পক্ষে রয়েছেন। মোদ্দাকথায়, অধ্যক্ষ আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাঁরই পক্ষ নিয়েছেন।

যদিও তদন্ত কমিটির সদস্যরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তবু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে তাঁদের তদন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তাহলে এখন করার কী আছে? আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা? না, আমরা বলি, এবার দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টা খতিয়ে দেখুক।