ক্ষমতাধর শাসক ও নাগরিক সমাজ

চীন তাদের রাষ্ট্রপতি সি চিন পিংকে নির্ধারিত দুই মেয়াদের ১০ বছর পরও ক্ষমতায় রাখতে চাইছে। দলের সর্বশেষ কংগ্রেসে তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নতুন ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তখনই বোঝা গিয়েছিল, চীন মাওয়ের পর আবার একক ক্ষমতার রাষ্ট্রনেতার শাসন পেতে যাচ্ছে। চীনের গত কয়েক দশকের প্রবৃদ্ধি জাতীয় বিকাশ ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করলেও এতে পুঁজিবাদী বিশ্বের মতোই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট হয়েছে। তবে দীর্ঘদিনের একদলীয় শক্ত শাসনের কারণে সামাজিক অস্থিরতার প্রকাশ এবং তা দমনের আতিশয্য তেমন প্রকাশ পাচ্ছে না। তা ছাড়া তিয়ান আন মানের পর শাসকেরা অনেক সতর্ক।

ক্ষমতাধর শাসকের উদ্ভব কোন পরিস্থিতিতে ঘটে, তার ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত সোভিয়েত নেতা স্তালিন। তিনি কীভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে এলেন এবং ক্রমে ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন? তাঁর নিজের প্রবণতা এবং তৎকালীন বাস্তবতার মধ্যে এর উত্তর মিলবে। রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের পরপর ইউরোপে ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে জারপন্থী জেনারেলরা সোভিয়েত রাষ্ট্র উৎখাতের উদ্দেশ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু করলে স্বভাবতই তা শক্ত হাতে দমনের প্রয়োজন দেখা দেয়। আর যেকোনো যুদ্ধ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দক্ষ নেতাকেই খুঁজে নেয়। এদিক থেকে অসুস্থ লেনিন ও ভাবুক ট্রটস্কির চেয়ে বাস্তববাদী স্তালিন এগিয়ে ছিলেন। তবে বিপ্লবী সরকার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করলেও দেশের অর্থনীতির বেহালদশা ঠেকাতে পারেনি। কঠিন খাদ্যসংকট ও বড় দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে আবারও প্রয়োজন হয় স্বাপ্নিক বিপ্লবী ও ভাবুক তাত্ত্বিক নেতার চেয়ে বাস্তববুদ্ধিতে পাকা শক্ত শাসকের। এতে স্তালিন এগিয়ে থাকলেন।

কঠিন সময়ে বিপ্লবের অংশীদার শ্রমিক ও কৃষকদের অসন্তোষ অনেক ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় রূপ নিলে দেখা গেল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও প্রলেতারীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্বে ও তর্কে লিপ্ত অন্যান্য বলশেভিক নেতার চেয়ে স্তালিনের ত্বরিত কঠোর ব্যবস্থা নতুন রাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়েছে। প্রেক্ষাপট বলে লেনিনের উত্তরসূরি নির্বাচনে পালিত্যে অতুলনীয় ও প্রজ্ঞানবাদী চিন্তাধারার ট্রটস্কিকে ছাপিয়ে প্রয়োগবাদী স্তালিন এগিয়ে ছিলেন। তিনি সংগঠনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে সাংগঠনিক শক্তি ও সিদ্ধান্তের দৃঢ়তায় প্রশাসন ও দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারী শিল্পের প্রসার ঘটে, লোকশিল্প ও গণস্বাস্থ্য এবং মেয়েদের অধিকার প্রাধান্য পায়।

স্তালিনের পোলিশ জীবনীকার আইজ্যাক ডয়েটশ্চার মনে করেন, বলশেভিকদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তা আর জার ইভানের ক্ষমতালিপ্সু আগ্রাসী স্বৈরশাসনের প্রবণতার সমন্বয়ে স্তালিনের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। আর সময় ও সুযোগ তাঁর অনুকূলেই ছিল। পরিবর্তনের বিপ্লবী কর্মযজ্ঞে সৃষ্ট অর্থনৈতিক-সামাজিক বিশৃঙ্খলায় সমাজের নিম্নবর্গের শ্রমিক-কৃষক এমন নেতার আশ্রয় চান, যিনি যুগপৎ শক্ত হাতে শাসন এবং উদারতার সঙ্গে খাওয়া-পরার সমস্যা মেটাবেন। ফলে ওই সময়ে তাঁদের স্তালিনের পক্ষে থাকাই ছিল যুক্তিযুক্ত। এ কথাও ঠিক, এমন শাসকই পেরেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হিটলারি আগ্রাসনের মুখে মরণপণ যুদ্ধে সোভিয়েত জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে, কোটি মানুষের প্রাণের আর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে অপরাজেয় নাৎসি বাহিনীকে লাল ফৌজের হাতে পদানত করতে। মানতেই হবে, স্তালিনের সেই কৌশল ও তার প্রয়োগ তৎকালীন বাস্তবতার আলোকে মানবসভ্যতার ভবিষ্যতের পথ কণ্টকমুক্ত করেছিল।

স্তালিনের মধ্যে শক্ত ধাতুর একগুঁয়ে স্বভাবের ব্যক্তিত্ব নিশ্চয় ছিল, কিন্তু তার বিকাশ অনিবার্য হয়ে ওঠে সমকালীন প্রতিকূল বাস্তবতার কারণে। তাঁর নিষ্ঠুরতা, বিশেষত বহু সুপরিচিত কমরেডকে হত্যার নির্মম প্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা বারবারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাঁর একনায়কি শাসন ক্রমেই দলবাজিতে সিদ্ধ আমলাতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিল। এ রকম চাপে যেকোনো ব্যবস্থার পক্ষে মানবিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা মুশকিল। তাঁর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও চাপ নিতে পারেনি, ভেঙে পড়ল, যার পূর্বাভাস ঘটনার অর্ধশতক বছর আগে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার অনেক প্রশংসার মধ্যেই: ‘এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলিনে; গুরুতর গলদ আছে। সে জন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে।’

শেষ পর্যন্ত সেই বিপদই ঘটেছে। নিশ্চয় দুর্যোগপূর্ণ সময় কেটে যাওয়ার পর জনগণের সত্যিকারের মুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার পথে চলা উচিত ছিল। প্রয়োজন ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু সব চরম ব্যবস্থার মতো একনায়ক নিজেই তৈরি করে নেন আত্মবিশ্বাসের এক মোহ, যার জালে তিনি ও তাঁর স্তাবকেরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তখন মুক্তিসংগ্রামী থেকে মুগাবেই তৈরি হন। একনায়কদের এই পরিণতি বিশ্ব বারবার দেখেছে। কিন্তু বাস্তব কারণেই বারবার তাঁরা সৃষ্ট হবেন।

বাংলাদেশে ক্ষমতাধর একক শাসকের চমৎকার চাহিদা তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অব্যবহিত পর। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক নেতার ভাবমূর্তি এবং তাঁর তখনকার বিপুল জনপ্রিয়তা মিলে গণতন্ত্রের আলখাল্লা চাপিয়েও দীর্ঘ একক শাসন সম্ভব ছিল। ভারতে আমৃত্যু জওহরলাল নেহরু টানা ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী থেকে দেশের অর্থনীতির অবকাঠামো ও গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিলেন, যার জোরে দেশটি অনেক দূর চলেছে। এভাবে সফল হতে অবশ্যই কেবল নেতার ত্যাগ ও আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে চলে না, চাই এমন কর্মিদল ও কর্মসংস্কৃতি, যাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং অন্যদের অংশগ্রহণের পরিবেশ বজায় থাকে। নানামুখী চাপে ও বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে আমাদের এই সুযোগ নষ্ট হয়। বহুকাল গণতন্ত্র ও সুশাসন অনুপস্থিত থাকল বাংলাদেশে।

আমরা দেখি, বাংলাদেশের সমাজমানসের মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন জাতীয় ইতিহাসে সব সময় ঠিকভাবে ঘটেনি। বায়ান্ন থেকে সূচিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১৯৭১-এ যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে স্বাধীনতা এনেছিল, তার সঙ্গে প্রথাগত সমাজমানসের দ্বন্দ্ব শাসক ও জনগণ কেউই উপলব্ধি করেনি। ফলে পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমানের পক্ষে খুব সহজে বায়ান্নর যাত্রাপথে কাঁটা বিছানো সম্ভব হয়েছে। এই উল্টো পথে হেঁটেই বাংলাদেশ সংবিধান, রাজনীতি ও সমাজের অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ এবং স্বপ্নগুলো ক্রমে হারিয়ে ফেলেছে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের দুই প্রধান দল, তাদের জনসমর্থনও কাছাকাছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সময়ে আওয়ামী লীগপ্রধানের একক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর কারণ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও তার জন্মের ইতিহাস ও নায়কদের অস্বীকার করতে পারবে না। এ কাজে বিএনপির আন্তরিকতাই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ নয়, তাদের রাজনীতির আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকদের দোসর জামায়াত এবং বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকারীদের প্রতি এই দলের দুর্বলতা কখনো গোপন থাকেনি। ফলে শ্রেণিগত ও দলীয় নেতা-কর্মীদের ভূমিকার অনেক সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত বিকল্পের অভাবে জাতির যাত্রাপথ ঠিক রাখার দায় থেকে অনেকেই দুই প্রধান দলের মধ্যে বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত বিবেচনায় নিতে পারেন না। সংগ্রামে-ত্যাগে অর্জিত জাতির লক্ষ্যাদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা একজন সুনাগরিক কীভাবে বাদ দেবেন? তাই বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁদের অন্তর্জ্বালা ও হতাশার শেষ নেই। এই বাস্তবতায় শেখ হাসিনার জন্য একক ক্ষমতাধর শাসক হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার পরিণতি যেন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

একদিকে সবটা মিলিয়ে তাঁর ওপর দায় চাপছে অনেক; অন্যদিকে যেকোনো ব্যর্থতা-দুর্ঘটনার দায় কেবল তাঁর ওপর চাপিয়ে কি নাগরিক সমাজ উদ্ধার পাবে? নাগরিক সমাজ কি এই বাস্তবতার মধ্যেও করণীয় দায় পালনের মতো স্বাধীন অবস্থান বজায় রেখেছে? বড় অংশই ব্যক্তিগত সুযোগ গ্রহণে আর বাক্‌সর্বস্ব নিষ্ক্রিয় আলোচনার পণ্ডশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে। স্বাধীন বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্ব ও ভূমিকা প্রায় অবান্তর বিষয় হয়ে পড়েছে। অনিশ্চয়তা ও সংকট আমাদের ছাড়ছে না।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক