তথ্য হাতানোর দৌড়ে নেমেছে চীনও?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের খবর চাউর হওয়ার পর ইউরোপীয় নেতারা নড়েচড়ে বসেছেন। তাঁদের নির্বাচনে যেন রাশিয়া একই কায়দায় সামাজিক যোগাযোগ ও ইন্টারনেটের অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে নাক গলাতে না পারে, সে জন্য তাঁরা সতর্কতা অবলম্বন করছেন। অন্যদিকে, চীনের নেতারাই শুধু সতর্ক হচ্ছেন তা নয়, বরং রাশিয়ার এই কায়দা রপ্ত করতে তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। দেশের অভ্যন্তরের সম্ভাব্য অসন্তোষ, চক্রান্ত বা অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে গত বাজেটে চীন নিরাপত্তা ব্যয়ের বরাদ্দ ধরেছে ১০ হাজার কোটি ডলার। এটি আনুষ্ঠানিক ঘোষিত বাজেট। প্রকৃত ব্যয় এর চেয়ে অনেক বেশি হবে। অভ্যন্তরীণ নজরদারি, গোয়েন্দা তৎপরতা, গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কাজে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করা হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তথ্য থেকে সামাজিক যোগাযোগের যাবতীয় তথ্য নজরদারিতে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সংক্ষেপে এআই) এবং উপাত্ত সম্ভার কাজে লাগানো যায় সেটি নিয়ে চীন কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য শুধু অভ্যন্তরীণ তথ্য-উপাত্তের প্রতি নজরদারি নয়, বরং বাইরের দেশ থেকে কীভাবে তথ্য ঢুকছে এবং দেশের বাইরে কীভাবে কোন কোন তথ্য পাচার হচ্ছে, তার নাড়ি-নক্ষত্র জানতে চায় চিন পিংয়ের সরকার। এর বাইরে সরকার নতুন নতুন কঠোর আইন এবং সাইবার সিকিউরিটি তদন্তের মাধ্যমে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে তার রাস্তায় আনার চেষ্টা করছে। ক্রেমলিন যে কায়দায় ফেসবুক ও টুইটারকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছিল, সেভাবে তারা যাতে চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সে জন্য সি চিন পিং আগে নিজের দেশের সাইবার সিস্টেম হাতের মুঠোয় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন।

চীনের সরকার সে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘উইচ্যাট’, ‘উইবো’ ও ‘টেনসেন্ট’-এর পর্ষদে এখন নিজেদের প্রতিনিধি বসানোর দাবি করেছে এবং এসব মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত সরকারের হাতে দেওয়ারও অনুরোধ জানিয়েছে। চীনের সাইবার গোয়েন্দারা রাশিয়ার সাফল্য নিয়েও গবেষণা করছেন। এটা প্রায় নিশ্চিত যে চীনের হ্যাকাররা প্রযুক্তিগত জ্ঞানে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। তারাও রাশিয়ার মতো মার্কিন নির্বাচনের প্রচারশিবির, চীনের বাইরে থাকা তিব্বতি আন্দোলন ও উইঘুর আন্দোলন শিবিরের ওয়েবসাইটে সফলভাবে সাইবার হামলা চালিয়েছে।

যেসব পশ্চিমা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় চীন নিয়ে গবেষণা করে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে তারা হামলা চালিয়েছে। এমনকি চীনের নেতাদের সহায়-সম্পত্তির হিসাব ফাঁস করে দিয়ে সরকারকে যেসব বিদেশি গণমাধ্যম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল, তাদের ওয়েবসাইটও তারা হ্যাক করেছে। তবে এত সাফল্যের পরও চীন মনে করে, ক্রেমলিনের কাছ থেকে এখনো তাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

দেশের সাইবার সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সি চিন পিং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যমের পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনের ‘সফট পাওয়ার’ বাড়াতে চাইছেন। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপকভাবে চীনের গোয়েন্দা তৎপরতার কথা সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থী, সে দেশে থাকা চীনা ব্যবসায়ী কিংবা কূটনীতিকেরা চীনা স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করছেন কি না, কিংবা কোনো তথ্য পাচার করছেন কি না, তা নজরদারির জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। চীনের একজন কোটিপতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কথা ফাঁস হওয়ার পর গত বছর অস্ট্রেলিয়ার একজন সিনেটরকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।

বিশ্ব গণমাধ্যম জগতেও চীন তার উপস্থিতি ক্রমেই বাড়াচ্ছে। কিছু সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর ডিজিটাল মিডিয়া ও সম্প্রচারের পেছনে চীন সরকার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ঢালছে। সরকারি বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার বিশ্বজুড়ে ১৭০টি ব্যুরো আছে এবং এটি আটটি ভাষায় সংবাদ সরবরাহ করে। চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশনের (সিসিটিভি) ৭০ টির বেশি ব্যুরো থেকে ৬টি ভাষায় ১৭১টি দেশে সংবাদ সম্প্রচার করা হয়। বিবিসির পরই বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেডিও ব্রডকাস্টার হচ্ছে চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল। সারা বিশ্বে এর ৯০টি রেডিও স্টেশন ও ৩২টি ব্যুরো আছে। ৬৪টি ভাষায় এই রেডিও থেকে খবর পড়া হয়। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা খুব দৃঢ় নয়, তারপরও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মতো যেসব অঞ্চল এখনো তথ্যের দিক থেকে পিছিয়ে আছে, সেখানে তাঁরা চীনের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে এবং চীনের প্রতি সংবেদনশীলতা ও সহমর্মিতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, অচিরেই সাইবার জগতের এক মহাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে চীন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
কেন্ট হ্যারিংটন সিআইএর সাবেক বিশ্লেষক